বিজ্ঞাপন
ছবিতে ইউএনও আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন, অফিসার ইনচার্জ মাছুদুল আমিন ও উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) অভিজিৎ চৌধুরী। ছবি : সংগৃহিত |
নিজস্ব প্রতিবেদক : স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের আগের দিন (৪ আগস্ট) সিলেটের গোলাপগঞ্জে ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশ, বিজিবি ও আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের সাথে সংঘর্ষের সময়ে তাদের করা গুলিতে ছয়জন নিহত হন। এসময় আহত হন প্রায় ২ থেকে ৩ শতাধিক ছাত্রজনতা।
একদিনে পুলিশে-বিজিবি ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের গুলিতে ৬জন নিহত হওয়ার ঘটনা গোলাপগঞ্জের ইতিহাসে এই প্রথম। ইতিপূর্বে সরকার বিরোধী কোনো আন্দোলন সংগ্রামে এই উপজেলায় এত তাজা প্রাণ একসাথে ঝরেনি। ভুক্তভোগী অনেকে দাবি করছেন (৪ আগস্ট) প্রশাসনিক এতা কঠোর ও অমানবিক না হলে হয়তো এতগুলো অমূল্য প্রাণ বেঁচে যেত। তাই তারা বলছেন এর দায় এড়াতে পারেনা গোলাপগঞ্জ থানার তৎকালীন দায়ীত্বরত পুলিশ সদস্য ও উপজেলা প্রশাসন।
শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ইন্ধনে নিরস্ত্র ছাত্রজনতার উপর দলদাস পুলিশ-বিজিবির এমন গুলি বর্ষণ কেবল প্রশ্নবিদ্ধই নয় বরং ন্যাক্কারজনক ঘটনা বলে অভিহিত করেছেন অনেকে। এই নৃশংস ঘটনার দায় কোনোভাবে এড়াতে পারেন না আন্দোলন দমনের নেতৃত্ব দেওয়া গোলাপগঞ্জ থানার তৎকালীন ওসি, ওসি তদন্ত ও ওসি অপারেশন এবং উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) অভিজিৎ চৌধুরী, উপজেলা নির্বাহী অফিসার আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন সহ পুলিশ ও প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তারা।
তবে এসিল্যান্ড অভিজিৎ চৌধুরীকে ১ মামলায় আসামি হলেও এই হত্যাকান্ডের নেতৃত্ব দেওয়া ওসি মাছুদুল আমিন, ইউএনও আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন সহ উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের অন্য কর্তাব্যক্তিদের নাম এজাহারে রহস্যজনক ভাবে না থাকায় সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এই আন্দোলন দমনে প্রশাসনের নির্দেশ দাতাদের এখন পর্যন্ত কোনো মামলায় নাম পদবী উল্লেখ করে আসামী করা হয়নি । ইউএনও স্বপদে বহাল থাকলেও ইতিমধ্যে থানার ওসিকে বদলি করা হয়েছে অন্যত্র।
গোলাপগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশ-বিজিবি ও সন্ত্রাসীদের গুলিতে ৬জন নিহত হওয়ার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৬টি হত্যা মামলা গোলাপগঞ্জ মডেল থানায় রেকর্ড হয়েছে। এর মধ্যে শুধুমাত্র ১টি মামলায় এসিল্যান্ড অভিজিৎ চৌধুরী ছাড়া প্রশাসনের কাউকে এজাহার ভুক্ত আসামি করা হয়নি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গোলাপগঞ্জ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মীর মোহাম্মদ আব্দুন নাসের।
এ বিষয়ে জানতে, উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) অভিজিৎ চৌধুরীকে একাধিক বার কল দিয়েও পাওয়া যায়নি।
এদিকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন বলছেন ভিন্ন কথা তিনি বলেন -
আমি হুকুমদাতা এমন বক্তব্য সামনা সামনি দিলে ভালো হত ! আমি বেশকিছু দিন থেকে গোলাপগঞ্জে কাজ করছি আমার কোনো কার্যক্রমে এরকম মনে হওয়ার কথা নয়। যারা শহীদ হয়েছেন আমি কয়েকজনের বাসায়ও গিয়েছি বাকিদের বাসায়ও যাব। প্রথমত, আমি যে গুলির হুকুম দিবো, আইন এরকম সুযোগই আমাকে দেয়নি।
থানায় রেকর্ড হওয়া এসব মামলার এজাহারে অনেক নিরীহ মানুষকে আসামি করা হলেও এ ঘটনার সাথে জড়িত প্রশাসন ও পুলিশ-বিজিবি সদস্যদের কেন আসামি করা হয়নি ? এমন প্রশ্নের জবাবে একটি মামলার বাদী পরিবারের এক সদস্য বলেন, মামলাতে প্রশাসনকেও আসামি করা হয়েছে হয়তো নাম উল্লেখ করা হয়নি।
এবিষয়ে আরেক বাদী অভিযোগ করে বলেন, আমাদের করা মামলায় প্রধান আসামি নুরুল ইসলাম নাহিদকে করেছিলাম বাকি আসামিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন, এএসপি (সার্কেল), ওসি, ইউএনও, এসিল্যান্ড, ওসি তদন্ত, ওসি অপারেশন সহ পুলিশ বিজিব'র সদস্যদরা। কিন্তু এই মামলাটি আমলে নেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ৪/৫ টি সাদা কাগজে আমাদের স্বাক্ষর নেন। পরে আমরা শুনি থানায় মামলা রেকর্ড হয়েগেছে। এতে প্রধান আসামি নুরুল ইসলামকে করা হলেও প্রশাসনের অভিযুক্ত অন্য কারো নাম এজাহারে উল্লেখ করা হয়নি।
এদিকে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করছে, এসব মামলায় আসামী করাকে কেন্দ্র করে আর্থিক লেনদেনের ঘটনা ঘটছে। খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে মামলায় আসামী তালিকায় নাম যুক্ত করে এবং এবং বাদ দিয়ে কেউ কেউ বড় অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
উল্লেখ্য গত (৪ আগস্ট) একদফা'র দাবিতে সারাদেশের মতো গোলাপগঞ্জও ছাত্রজনতার আন্দোলনে উত্তাল ছিল। সকাল ১১ টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে উপজেলার ঢাকা দক্ষিণের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণে এক বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। এসময় তারা একদফার পক্ষে নানা শ্লোগান দিয়ে বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে আসা মাত্র কর্তব্যরত এসিল্যান্ড অভিজিৎ চৌধুরীর উপস্থিতিতে গুলি করে বিজিবির সদস্যরা। এসময় ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ হন হাসান, ছানি ও নাজমুল নামের ৩ তরুন পরবর্তীতে হাসপাতালে নেওয়ার পর তারা মারা যান। এসময় বিজিবি'র একটি গাড়িও ভাংচুর করে ছাত্রজনতা।
এরপর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে পুলিশ-বিজিবির সাথে জনতার সংঘর্ষে নিজ দোকানের সামনে তাজ উদ্দিন নামের এক ব্যবসায়ী নিহত হন।
এদিকে ঢাকাদক্ষিণে শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার খবর যখন গোলাপগঞ্জ ছড়িয়ে পড়ে তখন গোলাপগঞ্জ পৌর শহর উত্তাল হয়ে উঠে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা একটি বড় মিছিল নিয়ে এম.সি একাডেমির সামনে থেকে পৌর শহরের চৌমুহনীতে আসে। মিছিল করে ফেরার সময় যখন তারা থানার সম্মুখে আসে পিছন থেকে আওয়মীলীগ ছাত্রলীগ হামলা করে তাদের উপর। এসময় পুলিশ সহ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীরা সশস্ত্র অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে সংঘর্ষ শুরু করে। তখন শিক্ষার্থীরাও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই সংঘর্ষে শিক্ষার্থীদের সাথে যোগ দেয় বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। এসময় গুলিবিদ্ধ হন গৌছ ও মিনহাজ নামের দুইজন হাসপাতালে নেওয়ার পরে তাদের মৃত্যু হয়।
উল্লেখ্য, আন্দোলনে পুলিশ-বিজিবি এবং সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন ৬জন। তারা হলেন, উপজেলার নিশ্চিন্ত গ্রামের মৃত তৈয়ব আলীর ছেলে নাজমুল ইসলাম (২৪), দক্ষিণ রায়গড় গ্রামের মৃত সুরই মিয়ার ছেলে হাসান আহমদ জয় (২০), শিলঘাট গ্রামের কয়ছর আহমদের ছেলে সানি আহমদ (২২), বারকোট গ্রামের মৃত মকবুল আলীর ছেলে তাজ উদ্দিন (৪০) দত্তরাইল বাসাবাড়ি এলাকার আলাই মিয়ার ছেলে মিনহাজ আহমদ (২৩), ঘোষগাঁও ফুলবাড়ি গ্রামের মোবারক আলীর ছেলে গৌছ উদ্দিন (৩৫)। এছাড়াও সিলেট নগরীর ক্বীন ব্রীজের পাশে পুলিশের গুলিতে মারা যান উপজেলার ঢাকাদক্ষিণ উত্তর কানিশাইল গ্রামের রফিক উদ্দিনের ছেলে ক্বারী মো: কামরুল ইসলাম পাবেল (২২)। সবমিলিয়ে ৭জন নিহত হলেও হতাহতের সংখ্যা ২ থেকে ৩ শতাধিক । বর্তমানে অধিকাংশ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও কিছু সংখ্যক ভুক্তভোগী এখনো সিলেট ও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন বলে জানা গেছে।