বিজ্ঞাপন
স্টাফ রিপোর্ট : সিলেটে একের পর এক বাড়ি থেকে বের হয়েই নিখোঁজ হচ্ছেন তরুণরা। এতে সিলেটে অভিবাবকদের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা দেখা দিয়েছে।
সর্বশেষ ১৩ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) সকাল ১০ টার দিকে বাড়ি থেকে জকিগঞ্জ সরকারি কলেজের যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়ে নিখোঁজ হয় সিলেটের জকিগঞ্জের আমিনুর রশিদ (১৮) নামের এক শিক্ষার্থী। এখন পর্যন্ত তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী (জিডি) করা হবেও জানা যায়
নিখোঁজ আমিনুর রশিদ জকিগঞ্জ উপজেলার উত্তর মনসুরপুর গ্রামের মৃত মাওলানা মো. আব্দুল মজিদের পুত্র।
এদিকে গত ৮ অক্টোবর বাড়ি থেকে বের নিখোঁজ হয়েছে মো. লিমন হোসেন (১২) নামের সিলেটের কাজিরবাজার মাদ্রাসার এক ছাত্র।
আত্মীয় স্বজনরা সম্ভব্য সকল স্থানে খোঁজা খুঁজির পর সন্ধান না পেয়ে বৃহস্পতিবার (১৩ অক্টোবর) এসএমপির কোতোয়ালী থানায় সাধারণ ডায়রী করেছেন। ডায়েরী নং-১৩৩২, তারিখ-১৩-১০-২২ইং।
নিখোঁজ হওয়া মো. লিমন হোসেন নগরীর জিন্দাবাজারস্থ মিতালী ম্যানশনের বাসিন্দা আবুল বাশার এর পুত্র এবং জামেয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া কাজিরবাজার মাদ্রাসার হিফজ বিভাগের ছাত্র।
জানা গেছে, গত ৮ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মাদ্রাসায় যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হলে লিমন হোসেন আর বাড়িতে ফিরে আসেনি।
পরে মাদ্রাসা ও আত্মীয় স্বজনরা সম্ভব্য সকল স্থানে খোঁজা খুঁজির পর তার সন্ধান না পেয়ে কোতোয়ালী থানায় সাধারণ ডায়েরী করেছেন নিখোঁজের পিতা আবুল বাশার।
এদিকে গত ৯অক্টোবর সিলেটের ওসমানীনগরে আমিরুল ইসলাম (১৬) নামের এক মাদ্রাসাছাত্র নিখোঁজ হয়।
আমিরুল ইসলাম ওসমানীনগর উপজেলার পশ্চিম পৈলনপুর ইউনিয়নের কিয়ামপুর গ্রামের খাইরুল ইসলামের (৪০) ছেলে।
সে উপজেলার উমরপুর টাইটেল মাদ্রাসায় আবাসিক ছাত্র ছিল। ওই ছাত্র হিজরতের নামে ঘর ছেড়েছে, নাকি অপহরণের শিকার হয়েছে, তা উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছে পুলিশ।
পরিবারের সদস্যরা জানান, ৭ অক্টোবর আমিরুল বাড়িতে আসার পর দুদিন অবস্থান করে ৯ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মাদ্রাসায় যাওয়ার জন্য বের হয়। এর পর থেকে তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনায় আমিরুলের বাবা খাইরুল ইসলাম ওসমানীনগর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন।
খাইরুল ইসলাম বলেন, ছেলে নিখোঁজের পর একটি মুঠোফোন নম্বর থেকে একাধিকবার যোগাযোগ করে টাকা দাবি করছে। ওই নম্বর থেকে পরিচয় গোপন করে এক ব্যক্তি একবার নেত্রকোনা, আরেকবার সিলেট নগরের লালবাজার এলাকায় ছেলে রয়েছে বলে জানায়। তবে ছেলের সঙ্গে কথা বলতে দিচ্ছে না। প্রথম দফায় ছেলের মায়ের মুঠোফোন নম্বরে ফোন দিয়ে এক হাজার টাকা নিয়েছে। এখন আরও টাকা দাবি করছে। বিষয়গুলো পুলিশকে জানানো হয়েছে।
খাইরুল ইসলাম বলেন, তাঁর তিন ছেলের মধ্যে আমিরুল সবার বড়। অন্য দুই ছেলের মধ্যে একজন ষষ্ঠ শ্রেণিতে এবং আরেকজন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। আমিরুল আবাসিক মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে মাসে একবার বাড়িতে এসে কদিন থাকে। গত ৭ অক্টোবরও বাড়িতে এসে দুই দিন পর ফিরেছিল। এরপর মাদ্রাসায় খোঁজ নেওয়ার পর জানা গেছে, সে আর মাদ্রাসায় যায়নি।
সিলেটের ওসমানীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস এম মাঈন উদ্দিন বলেন, নিখোঁজ ওই মাদ্রাসাছাত্রের সন্ধানে নেমেছে পুলিশ।
এর আগে গত বছরের ১৫ নভেম্বরে তাবলীগে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন ওসমানীনগর উপজেলার দয়ামীর গ্রামের চার তরুণ তাবলিগের কথা বলে গত বছরের ১৫ নভেম্বর বাড়ি ছেড়ে ছিলেন। এখন পর্যন্ত তাদের কোন খোঁজ পায়নি পুলিশ। উপজেলায় এ নিয়ে আলোচনার মধ্যেই মাদ্রাসার আরেক শিক্ষার্থী নিখোঁজ হলো।
আরো জানা যায়, ওসমানী নগরের এই চার তরুণ যেদিন নিখোঁজ হয়েছিলেন একই দিন নিখোঁজ হন সিলেট শহরের এলাকার বাসিন্দা তাহিয়াত চৌধুরী (১৮) নামের আরেক তরুণ। তাঁদের মূল বাড়ি জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কাদিমল্লিক গ্রামে।
সিলেটের এই ৫ তরুণ। কিন্তু এখনো বাড়ি ফেরেননি বা কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি এই পাচ তরুণের। পরিবারের সদস্যরাও জানেন না তারা কোথায় আছেন। অনেক খোঁজাখুঁজি করে তাঁদের সন্ধান না পেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন পরিবারের সদস্যরা।
নিখোঁজ ৫ তরুণ হচ্ছেন সিলেটের ওসমানী নগরের দয়ামীর গ্রামের শেখ আহমদ মামুন (২৩), মো. হাসান সায়িদ (২৪), সাইফুল ইসলাম ওরফে তুহিন (২৪) ও মো. সাদিকুর রহমান (৩৩)।
এদিকে গত সোমবার সংবাদ সম্মেলন করে নতুন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে ‘হিজরতের নামে ঘরছাড়া’ যে ৩৮ জনের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা র্যাব। এরমধ্যে সিলেটের নিখোঁজ ৫ যুবকেরও নাম ছিল।
নিখোঁজ তরুণদের পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘নিখোঁজ’ পাঁচজনের মধ্যে একজন শরীরচর্চাকেন্দ্রের (জিম) প্রশিক্ষক। একজন মাদ্রাসা থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করেছেন। অন্য তিন তরুণের মধ্যে দুজন শিক্ষার্থী। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, অন্যজন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছিলেন। একজন মাদ্রাসার পাঠ অসমাপ্ত রেখে পাহারাদার পেশায় নিযুক্ত ছিলেন।
নিখোঁজ তরুণেরা জঙ্গিবাদে জড়িত হয়েছেন বলে র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে যে তথ্য জানানো হয়েছে, এ সম্পর্কে তরুণদের স্বজনেরা অবহিত নন বলেও দাবি করেছেন।
তাহিয়াতের বাবা কামাল উদ্দিন চৌধুরী অনেক আগে দুবাইপ্রবাসী ছিলেন। এখন দেশেই থাকেন।
তিনি বলেন, তাহিয়াতের গত বছর সিলেটের জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাণিজ্য বিভাগ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। নিখোঁজের দিন উপশহর এলাকায় যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়ে তাহিয়াত আর ফেরেননি। তিন ছেলের মধ্যে তাহিয়াত সবার ছোট। তাঁর বড় ছেলে ফার্মেসি ব্যবসায় যুক্ত এবং দ্বিতীয় ছেলে শিক্ষার্থী ভিসায় যুক্তরাজ্যে আছেন।
তাহিয়াতের নিখোঁজের ঘটনায় জিডি হওয়ার পর থেকে পুলিশ সন্ধান চালাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিলেট মহানগরের শাহপরান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ আনিসুর রহমান। তবে তাঁর কোনো খোঁজ মেলেনি বলেও জানান তিনি।
নিখোঁজ সাদিকুর রহমান দয়ামীর বাজারের একটি শরীরচর্চাকেন্দ্রের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন। এ প্রতিষ্ঠানে তিনি প্রায় তিন বছর আগে কাজ নেন। স্থানীয় এক মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। পরে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে বিভিন্ন শরীরচর্চাকেন্দ্রে কাজ শুরু করেন। ২০১৮ সালে বিয়ে করেন। তাঁর চার বছরের এক মেয়েও রয়েছে।
সাদিকুরের স্ত্রী ফারজানা রিয়া বলেন, তাবলিগের কথা বলে তিনি (সাদিকুর) ঘর ছাড়েন। এক সপ্তাহ পরও যখন ফেরেননি, তখন থানায় পরিবারের পক্ষ থেকে জিডি করা হয়। সাদিকুরের তিন বোনের মধ্যে দুই বোন যুক্তরাজ্যে থাকেন। তাঁরা বিবাহিত। অপর বোন ও সাদিকুরের মা এখানে আছেন। নিরুদ্দেশের পর থেকে স্বামীর সঙ্গে আর তাঁর যোগাযোগ হয়নি বলে জানিয়েছেন রিয়া। যখন ছেলে জানিয়েছেন, একটা বিদেশি তাবলিগের দল এসেছে, তখন তিনি ভেবেছেন, হয়তো ছেলে তাবলিগেই যাচ্ছেন। এর পর থেকেই ছেলে নিরুদ্দেশ।
ছোরাব আলী, নিখোঁজ সায়িদের বাবা মো. হাসান সায়িদ ঢাকার ফরিদাবাদ মাদ্রাসা থেকে টাইটেল পাস করেন। এরপর বাড়িতে এসে যৌথভাবে পাথরের ব্যবসা শুরু করেন। তবে করোনা পরিস্থিতিতে ব্যবসায় লোকসান করে বাড়িতে বেকার দিন কাটাচ্ছিলেন।
সচ্ছল পরিবার তাঁদের। বাবা মো. ছোরাব আলী হাসান একসময় আরব আমিরাতপ্রবাসী ছিলেন। তবে দীর্ঘদিন ধরে তিনি দেশেই আছেন। নিখোঁজের পাঁচ মাস আগে পরিবারের সদস্যরা সায়িদকে বিয়ে করিয়েছেন। নতুন স্ত্রীকে বাড়িতে রেখেই তিনি তাবলিগে যাওয়ার কথা বলে নিরুদ্দেশ হন।
সায়িদের বাবা ছোরাব আলী বলেন, তাঁর ছেলে ভালো আরবি জানেন। যখন ছেলে জানিয়েছেন, একটা বিদেশি তাবলিগের দল এসেছে, তখন তিনি ভেবেছেন, হয়তো ছেলে তাবলিগেই যাচ্ছেন। এর পর থেকেই ছেলে নিরুদ্দেশ। অথচ নিরুদ্দেশের আগে অসুস্থ থাকায় তাঁকে (ছোরাব আলী) এক দিন আগে চিকিৎসকও দেখিয়েছেন সায়িদ। এভাবে ছেলে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে পারেন, এটা তাঁর কল্পনাতেও ছিল না।
শেখ আহমদ মামুনের ছোট ভাই শেখ আলী মাহিন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। তাঁরা দুই ভাই একই বিছানায় ঘুমাতেন।
মাহিন জানান, পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে শেখ আহমদ মামুন সবার বড়। তিনি সিলেটের লিডিং ইউনিভাসির্টিতে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিষয়ে দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সেমিস্টারে পড়তেন। নিখোঁজের পর থেকে মামুনের ফেসবুক আইডি ডিঅ্যাকটিভ বলে তিনি জানিয়েছেন।
নিখোঁজ সাইফুল ইসলাম স্থানীয় দারুল কোরআন মাদ্রাসায় টাইটেল পর্যন্ত পড়লেও চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেননি। এরপর পরিবারের সদস্যরা তাঁকে স্থানীয় একটা গ্যারেজে পাহারাদারের চাকরিতে নিযুক্ত করেন। নিখোঁজের আগ পর্যন্ত সেখানেই কাজ করছিলেন। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়।
সাইফুলের বাবা আবদুল মানিক জানান, নিখোঁজের পর থেকে পরিবারের কারও সঙ্গে সাইফুলের যোগাযোগ নেই। তাঁর অবস্থান কোথায়, সেটাও তাঁরা জানেন না।
ওসমানীনগর থানার ওসি এস এম মাঈন উদ্দিন বলেন, চার তরুণ একসঙ্গে নিরুদ্দেশ হয়েছেন বলে তাঁদের পরিবারের সদস্যরা ধারণা করছেন। তবে পুলিশ তাঁদের সন্ধান চালানো অব্যাহত রেখেছে। এখনো তাঁদের খোঁজ পাওয়া যায়নি।