বিজ্ঞাপন
ডেস্ক রিপোর্ট : উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া ১৯ জেলার ৫৫ তরুণের তালিকা প্রকাশ করেছে র্যাব। তাদের মধ্যে ৩৮ তরুণের নাম-পরিচয় শনাক্ত করেছে র্যাব। এদের মধ্যে অনেকে বিদেশে রয়েছেন বলে জানেন পরিবার-স্বজনরা। তারা মাঝে-মধ্যে বাড়িতে টাকাও পাঠান। এই ৩৮ তরুণের তালিকায় আছেন সিলেটের ৭ জন ও সুনামগঞ্জের ১ জন।
তবে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে দুই দফায় নিরুদ্দেশ হওয়া ৬ তরুণসহ মোট ১২ জনকে গ্রেপ্তারের পর র্যাব বলছে, অন্তত ৫৫ জন কথিত হিজরতের নামে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। যাদের মধ্যে ৩৮ জন পার্বত্য চট্টগ্রাম দুর্গম এলাকায় অবস্থান করছেন। তাদের অনেককে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ ও বোমা বিস্ফোরণের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে এমনটিই দাবি করেছে র্যাব।
জঙ্গি সম্পৃক্ততায় কুমিল্লা ও দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বাড়ি ছেড়ে যাওয়া সঙ্গে জড়িত সংগঠনের দাওয়াতি ও অন্যতম অর্থ সরবরাহকারী হাবিবুল্লাহ ও বাড়ি ছেড়ে যাওয়া তিনজনসহ মোট পাঁচজনকে গতকাল রোববার (৯ অক্টোবর) রাতে রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ী ও কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে গ্রেপ্তারের পর এসব তথ্য জানায় র্যাব।
সোমবার (১০ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, সিলেটের ৭ জন, সুনামগঞ্জের ১ জন, নারায়ণগঞ্জের ৪ জন, নেত্রকোণার ১ জন, নোয়াখালীর ১ জন, পটুয়াখালীর ১ জন, ফরিদপুরের ২ জন, বরিশালের ৩ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ১ জন, ময়মনসিংহের ১ জন, মাগুরার ১ জন, মাদারীপুরের ২ জন, কুমিল্লার ১৫ জন, খুলনার ১ জন, চাঁদপুরের ১ জন, ঝালকাঠির ২ জন, ঝিনাইদহের ১ জন, টাঙ্গাইলের ১ জন ও ঢাকার ৪ জন তরুণ নিখোঁজ রয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, গত ২৩ আগস্ট কুমিল্লা সদর এলাকা থেকে ৮ তরুণের নিখোঁজের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় নিখোঁজ সংক্রান্তে গত ২৫ আগস্ট কুমিল্লার কোতয়ালী থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। ওই ঘটনায় র্যাব নিখোঁজ ও ভুক্তভোগীদের উদ্ধারে ও জড়িতদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।
তদন্তকালে জানা যায়, জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা গৃহ ত্যাগ করেছে। এরই মধ্যে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ৬ সেপ্টেম্বর ঘর ছাড়ার প্রস্তুতিকালে ৪ তরুণকে হেফাজতে নিয়ে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয় র্যাব।
গত ১ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ হওয়া ৮ তরুণের মধ্যে শারতাজ ইসলাম নিলয় (২২) নামের একজন রাজধানীর কল্যাণপুরের নিজ বাড়িতে ফিরে আসে।
নিলয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে গত ৬ অক্টোবর মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে জঙ্গি সংগঠনের দাওয়াতী, তত্ত্বাবধানকারী, আশ্রয় প্রদান কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ৩ জন ও নিরুদ্দেশ ৪ তরুণসহ ৭ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব। গ্রেফতাররা উগ্রবাদী সংগঠনটির সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয়।
এরই ধারাবাহিকতায় গত রাতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১০ এর যৌথ অভিযানে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও কেরাণীগঞ্জ এলাকা থেকে কুমিল্লার শাহ মো. হাবিবুল্লাহ ওরফে হাবিব (৩২) ও নেয়ামত উল্লাহ (৪৩), ঢাকার মোহাম্মদপুরের মো. হোসাইন (২২), ঢাকার সূত্রাপুরের রাকিব হাসনাত ওরফে নিলয় (২৮) এবং নোয়াখালীর সাইফুল ইসলাম ওরফে রনি ওরফে জায়দ চৌধুরীকে (১৯) গ্রেফতার করে র্যাব। উদ্ধার করা হয় ৫টি উগ্রবাদী পুস্তিকা, প্রায় তিনশ লিফলেট এবং ৫টি ব্যাগ।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কোমলমতি তরুণদেরকে সংগঠনের সদস্যরা টার্গেট করে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন নিপীড়নের বিভিন্ন ভিডিও দেখিয়ে ও বিভিন্ন অপব্যাখ্যা দেওয়ার মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করতো।
উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ তরুণদের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যরা রাজনীতি, সমাজ ব্যবস্থা সংক্রান্ত বিভিন্ন অনিয়ম, ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও বিভিন্ন তাত্ত্বিক জ্ঞান দিতো। সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতি নিতে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়ে উৎসাহী করে তুলতো।
কেউ দুই মাস, কেউ এক বছর পূর্বে ঘর ছেড়ে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়। গ্রেফতার হোসাইন এক বছর আগে, গ্রেফতার সাইফুল দেড় মাস আগে এবং গ্রেফতার রাকিব দুই মাস আগে নিখোঁজ হয়।
জানা গেছে, নিখোঁজ হওয়া তরুণদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতির জন্য প্রশিক্ষণ নিতে পটুয়াখালী ও ভোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রেরণ করা হয়। নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণদেরকে বিভিন্ন সেইফ হাউজে রেখে পটুয়াখালী এলাকার বিভিন্ন ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে রেখে পটুয়াখালী ও ভোলার বিভিন্ন চর এলাকায় শারীরিক কসরত ও জঙ্গিবাদ বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এছাড়াও আত্মগোপনে থাকার কৌশল হিসেবে তাদের রাজমিস্ত্রী, ইলেক্ট্রিশিয়ানসহ বিভিন্ন পেশার প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।
নিখোঁজ অর্ধশতাধিক, তালিকাভুক্ত ৩৮ জন :
বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তারদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণের সংখ্যা ৫০ এর অধিক। যারা প্রায় দেড় মাস থেকে দুই বছরের অধিক সময় ধরে নিরুদ্দেশ বা নিখোঁজ। এদের মধ্যে কয়েকজনের পরিবার জানেন যে, তারা চাকুরির জন্য বিদেশে অবস্থান করছেন এবং নিয়মিত পরিবারকে অর্থ প্রদান করতো।
এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, প্রাথমিকভাবে সংগঠনের গ্রেপ্তার সদস্যদের মাধ্যমে আমরা ৩৮ জনের তথ্য জানতে পেয়েছি, যাদের নাম ও ঠিকানা পাওয়া গেছে। ক্ষেত্র বিশেষে নাম ও ঠিকানায় কিছুটা তারতম্য থাকতে পারে। তাদের অবস্থান পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলে। সেখানে তারা বিভিন্ন সংগঠনের ছত্রছায়ায় আত্মগোপনে থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে এবং সংগঠনটির বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত এ তথ্যসমূহ দেশের সব গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন বাহিনীকে জানানো হয়েছে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সম্মিলিত অভিযান চলমান রয়েছে।
তালিকায় থাকা ৩৮ জন হলেন- মো. দিদার, তাহিয়াত চৌধুরী, আহাদ, মশিউর রহমান, সাখাওয়াত হোসাইন, আরিফুর রহমান, মো. নঈম হোসেন, শামীম মিয়া, আল আমিন ফকির, আমিনুল ইসলাম, মো. নাজমুল আলম নাহিদ, আল আমিন, শেখ আহমদ মামুন, মো. আস সামি রহমান, সাদিক, হাসান সাঈদ, বায়েজিদ, জুয়েল মুসল্লী, ইমরান রহমান শিথিল, সাইফুল ইসলাম তুহিন, আল আমিন, ইমরান, শিব্বির আহমদ, হাবিবুর রহমান, মুহাম্মদ আবু জাফর, যুবায়ের, নিহাদ আব্দুল্লাহ, মাহমুদ ডাকুয়া, আমির হোসেন, নাহিদ, সালেহ আহমাদ, রাব্বী আবদুস সালাম, ইয়াছিন ব্যাপারী, মো. মিরাজ সিকদার, ওবায়দুল্লাহ সাকিব, জহিরুল ইসলাম, আবু হুরায়রা ও আবুল বাশার মৃধা।
উগ্রবাদের অর্থায়ন করছে গ্রেপ্তার হাবিবুল্লাহ :
গ্রেপ্তার হাবিবুল্লাহ কুমিল্লায় কুবা মসজিদের নামাজ পড়াতেন। এছাড়াও তিনি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন, তিনি ২০২০ সালে নেয়ামত উল্লাহর মাধ্যমে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া (পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দের জামাতুল আনসার) সংগঠনটিতে যুক্ত হন। তিনি সংগঠনটির অন্যতম অর্থ সরবরাহকারী। তার নেতৃত্বে কুমিল্লা অঞ্চলে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালিত হতো। তিনি সংগঠনের জন্য বিভিন্নভাবে অর্থ সংগ্রহ করতেন ও উগ্রবাদী কার্যক্রমে অর্থ সরবরাহ করতেন।
তিনি পার্বত্য অঞ্চলের নাইক্ষংছড়িতে তিনি প্রায় দুই বছর ধরে একটি মাদারাসা পরিচালনা করছেন। তিনি পাহাড়ের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছাত্র সংগ্রহ করে তার মাদ্রাসায় রাখতেন। তিনি ১৫-২০ জন সদস্য সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণে প্রেরণ করেছেন বলে জানায়।
গ্রেপ্তার নেয়ামত উল্লাহ কুমিল্লার একটি মহিলা মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। তিনি ২০১৯ সালে স্থানীয় একটি ব্যক্তির মাধ্যমে সংগঠনে যুক্ত হয়। তিনি সংগঠনের দাওয়াতী কার্যক্রমে যুক্ত থাকার পাশাপাশি নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণদের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বেও জড়িত ছিলেন। বাড়ি ছেড়ে যাওয়া সদস্যদের তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে আশ্রয় দিতেন বলে জানায়।
গ্রেপ্তার হোসাইন পেশায় একজন ইলেকট্রিশিয়ান এবং রং মিস্ত্রী। তিনি স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হন। দীর্ঘ এক বছর ধরে তিনি সংগঠনের বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত।
গ্রেপ্তার রাকিব কুরিয়ার সার্ভিসে ডেলিভারি বয়ের কাজ করতেন। তিনি গ্রেফতার হোসাইনের মাধ্যমে সংগঠনে জড়িত হয়। উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি প্রায় দুই মাস আগে নিরুদ্দেশ হন।
গ্রেপ্তার সাইফুল পেশায় একজন রাজমিস্ত্রী। তিনি গত আগস্ট মাসে নোয়াখালী থেকে জঙ্গিবাদে উদ্বুব্ধ হয়ে নিরুদ্দেশ হন। তিনি নোয়াখালীর এক ব্যক্তির মাধ্যমে উগ্রবাদী এই সংগঠনে জড়ান।
এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেপ্তার হাবিবুল্লাহ বিভিন্ন নামে-বেনামে মাদরাসা মসজিদের জন্য চাঁদা সংগ্রহ করে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার (পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দের জামাতুল আনসার) জন্য অর্থায়ন করতেন। আমরা এখনো প্রাথমিক স্তরে কাজ করছি।
নিখোঁজদের কেউ দেশ ছেড়েছে, তারা কীভাবে টাকা পাঠাতেন পরিবারে? জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, এখন পর্যন্ত নিখোঁজ ৩৮ জনের কাউকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারিনি। দুই দফায় ৬ তরুণসহ গ্রেপ্তার ১২ জন এ তালিকার বাইরে। তাদের ৩৮ জনের কাউকে গ্রেপ্তার করা গেলে বোঝা যাবে কেউ দেশ ত্যাগ করেছে কি না। নিখোঁজদের কেউ কেউ পরিবারে টাকা দিচ্ছেন, পরিবার জানে তারা বিদেশে। তবে তারা দেশে থেকেই অল্প কিছু টাকা পরিবারে পাঠাচ্ছেন। ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা।
কমান্ডার মঈন বলেন, এটা অবশ্যই এলার্মিং যে নিরুদ্দেশ হয়ে ঘরছাড়া। আমরা চেষ্টা করছি জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে রাখতে। এটা চলমান প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের জনগণ কখনোই জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয়নি। আমরাও কাজ করে যাচ্ছি।