বিজ্ঞাপন
ডেস্ক রিপোর্ট : ‘আমার ছেলে বইয়ে ইলিশ মাছের ছবি দেখিয়ে বলে- এইটা কি মাছ? এর স্বাদ কেমন? আমি জবাব দিতে পারি না। কারণ ইলিশ মাছের স্বাদ তো আমিই জানি না। কোনদিন খাইনি। অথচ এটা নাকি আমাদের জাতীয় মাছ। তবে আমাদের কাছে জাতীয় মাছ হলো পাঙ্গাস। পাঙ্গাস ছাড়া কোন মাছ কেনার সামর্থ চা শ্রমিকদের নেই।’
এক নাগারে কথাগুলো বললেন সিলেটের আলী বাহার চা বাগানের শ্রমিক মিথিলা ফারজানা। তিনি বলেন, ১২০ টাকায় কি হয়? গন্তানদেও মুখে কোনদিন ভালো খাবার দিতে পারি না। কাপড় দিতে পারি না।
৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে শনিবার দুপুরে মালনীছড়া চা বাগানে বিক্ষোভ সমাবেশ করে সিলেটের বিভিন্ন চা বাগানের শ্রমিকরা। সেখানেই এমন কথা বলেন তিনি। এরআগে দুপুরে আধঘন্টা মতো আম¦রখানা-ওসমানী বিমানবন্দর সড়ক অবরোধ করে রাখেন তারা। পরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের আশ্বাসে অবরোধ প্রত্যাহার করে মালনীছড়া বাগানের মন্ডপের সামনে অবস্থান নেন তারা। আজকের মধ্যে দাবি আদায় না হলে কাল থেকে আরও কঠোর কর্মসূচীরও হুশিয়ারি দেন শ্রমিকরা।
সেখানেই কথা হয় মোমিন হোসেনের সাথে। আলী বাহার চা বাগানের শ্রমিকের সন্তান তিনি। মোমিন বলেন, আমরা ৩০০ টাকা মজুরির দাবি জানালাম। কিন্তু আমাদের মাত্র ২৫টাকা মজুরি বাড়ানো হলো। আমরা কি ভিক্ষুক? আমরা কি তাদের কাছে ভিক্ষা চাই?
১২০ টাকা মজুরি দিয়ে বাচ্চাদের লেখাপড়া করাতে পারেন না জানিয়ে মালনী ছড়া চা বাগানের শ্রমিক সুফই বিবি বলেন, আমরা বাচ্চাদের লেখাপড়া করাতে পারি না। আমাদের সন্তানরাও তাই চা শ্রমিকই থাকছে, অন্য কিছু হতে পারছে না। শিক্ষাকে কলা হয় মৌলিক অধিকার। আমরা কেন এই অধিকার থেকে বঞ্চিত। আমরা কি মানুষ না?
৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে গত ১৩ আগস্ট থেকে লাগাতার ধর্মঘট পালন করছেন দেশের ১৬৬ চা বাগানের শ্রমিকরা। শনিবার শ্রমি অধিদপ্তরের সাথে শ্রমিক ইউনিয়ন নেতাদের বৈঠক হয়। বৈঠকে মজুরি ২৫ টাকা বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা প্রদানের প্রস্তাব দেয়া হয়। এই প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে শনিবার বিকেলে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন শ্রমিক নেতারা। তবে সাধারণ শ্রমিকরা এমন সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করে বিক্ষোভ শুরু করে। তারা ধর্মঘট অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। পরে শনিবার রাতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে শ্রমিসক ইউনিয়ন নেতারাও দাবি আদায়ে ধর্মঘট অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন।
শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেও রোববার সিলেটের কর্মসূচীতে তাদের দেখা যায়নি। এসময় বিক্ষোভকারীরা শ্রমিক নেতাদের বিষেদগার করে বক্তব্য দিতে দেখা যায়।
মালনীছড়া চা বাগানের শ্রমিক বিথি বাউরি বলেন, মালিকপক্ষে দালালদেও কথায় আমরা আন্দোলন বন্ধ করবো না। আমরা যখন রাজপথে নেমেছে দাবি আদায় করেই ছাড়বো। ৩০০ টাকা মজুরির দাবি আদায় ছাড়া রাজপথ ছাড়বো। নেতাদেও কোন প্রহসনের সমঝোতায় আমরা পিছু হটবো না।
তিনি বলেন, আমাদের শ্রমে মালিকরা কোটি কোটি টাকা কামায়। অথচ আমাদেও মাত্র ৩০০ টাকা দিতে তাদের এতো টালবাহানা কেন?
তবে শ্রমিকদের আন্দোলনে বহিরাগতরা ঢুকে পরেছে অভিযোগ করে চা শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, আমরাও শ্রমিকদের দাবির সাথে একমত। তাদের স্বার্থেই আমরা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছি। কিন্তু অনেক জায়গায় দেখতে পাচ্ছি শ্রমিকদের আন্দোলনে বহিরাগতরা ঢুকে পরেছে। তারা শ্রমিকদের ইন্ধন দিচ্ছে। এতে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটারও শঙ্কা রয়েছে।
আন্দোলনের অংশ হিসেবে শনিবার সকাল থেকেই মালনীছড়া চা বাগানে অবস্থান নেন শ্রমিকরা। রোববার সাধারণ শ্রমিকদেরকেই নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় আন্দোলনে। দুপুরে বিভিন্ন বাগান থেকে মিছিল নিয়ে শ্রমিকরা এসে জড়ো হন মালনীছড়ায়। বেলা সাড়ে ১২ টার দিকে তারা সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর সড়ক অবরোধ করেন।
পরে বেলা ১ টার দিকে জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী সেখানে উপস্থিত হয়ে শ্রমিকদেও দাবি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে তুলে ধরার আশ্বাস দিলে শ্রমিকরা অবরোধ প্রত্যাহার করে।
এরপর মালনীছড়া বাগানের মন্ডপের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখেন তারা।
আলী বাহার চা বাগানের শ্রমিক নেত্রী রিমা নায়েক বলেন, আমাদের পড়নের কাপড় নাই। ঘরে ভাত নাই। সন্তানরা অভূক্ত। তবু আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন থেকে সরবো না।
তিনি বলেন, নেতাদের আশ্বাসে আমরা আজ সড়ক অবরোধ প্রত্যাহার করেছি। আজ রাত পর্যন্ত দেখবো। রাতের মধ্যে দাবি পুরণ না হলে কাল সকাল থেকে আমরা আবার সড়ক অবরোধ করবো।