বিজ্ঞাপন
ডেস্ক রিপোর্ট : স্বামীর প্রতি ক্ষোভ ও অভিযোগ থেকে ঘৃণা জন্ম নেয় নাজমিন জাহানের। ‘অযত্ন, অবহেলা আর অপবাদ’ সইতে হয়েছে দীর্ঘদিন থেকে। নিজেকে মানসিক রোগী ‘সিক’ (অসুস্থ) দাবি করলেন নিজের সন্তানকে হত্যাকারী মা নাজমিন জাহান (২৮)।
নাজমিন সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ বাদেপাশা ইউনিয়নের কালিকৃষ্ণপুর গ্রামের মো. জিয়া উদ্দিনের মেয়ে। তিনি সিলেটের একটি বেসরকারি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষিকা। গতকাল বুধবার (৯ ফেব্রুয়ারি) নিজের গর্ভে ধরা ১৬ মাস বয়েসি সন্তানকে বালিশচাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। পরে পুলিশের কাছে লোমহর্ষক বর্ণনার মাধ্যমে এ হত্যার কথা স্বীকার করেন তিনি।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নিহত শিশুর নাম নুসরাত জাহান সাবিহা। তার বাবা সাব্বির আহমদ সিলেট দক্ষিণ সুরমার বলদি এলাকার বাসিন্দা ও কাতার প্রবাসী। সম্প্রতি সাব্বির দেশে ছুটিতে এসেছেন। কিন্তু সাব্বিরের সঙ্গে নাজমিনের বনিবনা না থাকায় তিনি (নাজমিন) শাহপরাণ এলাকার নিপোবন-৪৯ এ আলাদা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন। সঙ্গে তার ছোট বোন ও আগের স্বামীর ঘরের ১১ বছরের এক সন্তান থাকতেন। স্বামীর সঙ্গে পারিবারিক কলহের এক পর্যায়ে বুধবার বেলা ২টার দিকে ১৬ মাস বয়েসি শিশু সাবিহার মুখে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন নাজমিন। এসময় বিষয়টি দেখতে পেয়ে নাজমিনের কবল থেকে তার বোন ও প্রতিবেশী এক মহিলা শিশুটিকে উদ্ধার করে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক সাবিহাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এসময় হাসপাতাল থেকে নাজমিন পালাতে চেষ্টা করলে উপস্থিত লোকজন তাকে আটক করে পুলিশে খবর দেন। পরে কোতোয়ালি থানার একদল পুলিশ গিয়ে তাকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে।
থানায় আসার পর পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাংবাদিকদের সামনে নিজের শিশু মেয়েকে হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দেন নাজমিন। এসময় তিনি বলেন, ২০১৫ সালের মে মাসে সাব্বির হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। বিয়ের ৬ মাস পর সাব্বির বিদেশে চলে যান। পরে তিনি শাহপরান এলাকার নিপোবন-৪৯ নং বাসায় থেকে সিলেটের একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করতে থাকেন।
নাজমিনের অভিযোগ, বিদেশের যাওয়ার পর থেকে স্বামী সাব্বির আর তার খোঁজ নেননি। ভরণ-পোষণও করেননি। বিদেশে থাকা অবস্থায় সাব্বির পরিচিতজনদের মাধ্যমে নাজমিনকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা বলতেন। এমন অবস্থায় চার বছর পর ২০২০ সালে দেশে আসেন সাব্বির। দেশে এসে নাজমিনকে বুঝিয়ে আবার সংসার শুরু করেন তিনি। তখন নাজমিন গর্ভবতী হন। তাকে গর্ভবতী রেখে সাব্বির আবারও কাতার চলে যান। তবে প্রবাসে যাওয়ার পরপরই গর্ভের সন্তান নিজের নয় বলে দাবি করেন সাব্বির।
নাজমিন বলেন, আমি তখন ডিএনএ টেস্ট করার কথা বলি। কিন্তু এরপরও সাব্বির আমার বিরুদ্ধে পরিচিত সকলের কাছে কুৎসা রটাতে থাকে এবং আমাকে অপবাদ দিতে থাকে। তবে জন্মের পর মেয়ের চেহেরা অবিকল তার বাবার মতো হওয়ায় মানুষের প্রশ্ন থেকে আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
নাজমিন আরও বলেন, সাব্বির ১৫ দিন আগে দেশে এসেছেন। কিন্তু আমার কাছে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। চার-পাঁচ দিন পর পর শুধু কয়েক মিনিটের জন্য মেয়েকে দেখতে যান। কিন্তু আমি স্ত্রী হিসেবে তাকে কাছে পাইনি।
স্বামীর বিরুদ্ধে চরিত্রহীনতার অভিযোগ এনে নাজমিন বলেন, ও পরকীয়া করে। বহু নারীর কাছে যায়। একজনের সঙ্গে পরকীয়া করলে হয়তো তাকে ফেরাতে পারতাম।
কিন্তু সবকিছুর পরে নিজের সন্তানকে হত্যা করলেন কেন? সে তো নির্দোষ ছিলো? পুলিশের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার তো সব শেষ। আমার জীবনকে একেবারে নষ্ট করে দিয়েছে সাব্বির। নিজের সন্তানকে- আমাকে সময় দেয় না। আমাকে জিন্দা লাশ করে ফেলছে সে। তাই আমার মাথা কাজ করেনি। তার প্রতি ক্ষোভে-কষ্টে মেয়েকে বালিশচাপা দেই। আমি ইমোশন থেকে আমার বাচ্চাটাকে মারছি। কিন্তু বালিশাচাপা দেওয়ার পর আমার আবেগ জেগে ওঠে। আমি আমার মেয়েকে মারার পর তাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরি এবং অনেক্ষণ কান্না করি। এসময় আমার বাচ্চার হৃদস্পন্দন আমি বুঝতে পারি। ওইসময় বাড়িওয়ালি এসে আমার কাছ থেকে আমার মেয়েকে নিয়ে নেন। এর পরপরই আমার মেয়ে হড়হড়িয়ে বমি করে। পরে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিজের মেয়েকে হত্যার দায় স্বীকার করে নাজমিন বলেন, আমি কাউকে ফাঁসাবো না। সাব্বিরকেও ফাঁসাবো না। সব দোষ আমার। আমি আমার মেয়েকে খুন করছি। আমার ফাঁসি হোক। আপনারা আমাকে ফাঁসি দিন। অথবা কেউ আমার দুটো হাত কেটে ফেলুন। আপনারা যদি আমাকে শাস্তি না দেন তবে আমি যে কোনো সময় সুইসাইড করতে পারি।
এদিকে, নাজমিনের স্বামী সাব্বির আহমদকেও গতকাল বিকালে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদের পর সাব্বির বাদি হয়ে নাজমিনকে আসামি করে শাহপরাণ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলা নং-১১।
বিষয়টি আজ (বৃহস্পতিবার- ১০ ফেব্রুয়ারি) সকালে নিশ্চিত করেছেন মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) শাহপরাণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ আনিসুর রহমান।
তিনি বলেন, নাজমিনকে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। আজ তাকে আদালতে প্রেরণ করা হবে।
সংবাদ : সিলেটভিউ২৪।