বিজ্ঞাপন
ডেস্ক রিপোর্ট : ঢাকা-সিলেট মহাসড়কসহ দেশের বিভিন্ন মহাসড়ক ঘিরে আন্তঃজেলা ডাকাতদের অন্তত ২৫টি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। প্রতি গ্রুপের হয়ে ১২ থেকে ২৪ ডাকাত কাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও পরিবহণ মালিকরা বলছেন, ডাকাতি প্রতিরোধ এবং ডাকাতের কবল থেকে যাত্রীদের রক্ষা করতে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনা বৃদ্ধি পেলেও এ ব্যাপারে কারও কাছেই কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
জানা গেছে, মহাসড়কে বিভিন্ন যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী ট্রাক এবং প্রাইভেট পরিবহণ প্রায় ডাকাতের কবলে পড়ছে। অভিযোগ, ডাকাতির ঘটনায় মামলা করতে গিয়ে হয়রানির ভয়ে অনেক ভুক্তভোগী থানায় যান না। এতে আড়ালেই থেকে যায় অনেক ঘটনা। এছাড়া মহাসড়কের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা হাইওয়ে পুলিশের বিরুদ্ধেও ব্যর্থতার অভিযোগ ওঠেছে।
পরিবহণ চালকরা জানান, চাঁদা তোলা ছাড়া হাইওয়ে পুলিশের তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। তবে হাইওয়ে পুলিশের দাবি- তারা ডাকাতি প্রতিরোধে কাজ করছে।
হাইওয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শামছুল আলম সরকার সোমবার বলেন, মহাসড়কে ডাকাতি প্রতিরোধে হাইওয়ে পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া তালিকা ধরে ডাকাতদের গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির মহাসচিব ও এনা পরিবহণের মালিক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ সোমবার বলেন, নাইট কোচে যাত্রীদের ভিডিও ধারণ, কাউন্টার ছাড়া যাত্রী না তোলা এবং যাত্রাপথে রেস্তোরাঁয় বিরতির পর আবার ভিডিও করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, মহাসড়ক ছাড়া কোনো বাইপাস সড়ক বা স্থানীয় সড়ক ব্যবহার না করতে পরিবহণ চালক-শ্রমিকদের নির্দেশ দেওয়া আছে।
সোহাগ পরিবহণের মালিক ফারুক তালুকদার সোহেল সোমবার বলেন, ডাকাতদের কবল থেকে যাত্রীদের সুরক্ষিত থাকতে তারা রাতের এসি গাড়িগুলোতে যাত্রীদের ছবি তুলে রাখেন। আর নন-এসি গাড়িগুলোতে চালকদের পাশে গ্রিল দেওয়া হয়েছে। রাতে গ্রিল লক করে রাখা হয়।
তিনি আরও বলেন, কোনো ডাকাত যাত্রীবেশে উঠলেও চালককে যাতে জিম্মি করে বাসের নিয়ন্ত্রণ না নিতে পারে সেজন্য এ ব্যবস্থা।
তিনি বলেন, এ পদ্ধতি অবলম্বন করে তারা বেশ ভালো ফল পেয়েছেন। তিনি বলেন-চালক, শ্রমিক ও যাত্রীদের সুরক্ষিত রাখতে এ ধরনের কৌশল সব পরিবহণের করা উচিত।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মহাসড়কে যারা ডাকাতি করে তারা দিনে ছোটখাটো পেশাজীবীর ছদ্মবেশে থাকে। তবে রাতের আঁধারে তারাই হয়ে উঠে ভয়ংকর। বেশিরভাগ সময় যাত্রীবেশে গাড়িতে উঠে চালক-হেলপারকে জিম্মি করে তারা ডাকাতি করে। যাত্রীদের নির্যাতনের পর হাত-পা বেঁধে রাস্তার পাশে নির্জন স্থানে ফেলে দেওয়া হয়। আবার নির্জন স্থানে গাছের গুঁড়ি ফেলে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে কয়েকটি চক্রে ডাকাতি করে। পণ্যবোঝাই ট্রাক অথবা কাভার্ড ভ্যান ছিনিয়ে নিয়ে তারা মালামাল বিক্রি করে দেয়। এরপর লুটের গাড়ি নিয়ে ঘুরে ঘুরে ডাকাতি করে।
২০ জানুয়ারি ঢাকার আব্দুল্লাহপুর থেকে বাসে টাঙ্গাইলে যাওয়ার পথে ডা.শফিকুল ইসলাম ডাকাতের কবলে পড়েন। এ ঘটনা তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরলে তা ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই পুলিশ মাঠে নামে। ওই ঘটনাসহ সাতটি ডাকাতির ঘটনায় ২২ ডাকাতকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করেছে। কয়েকজন ডাকাতের স্বীকারোক্তিতে রোমহর্ষক ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। ১৪ জানুয়ারি বগুড়া থেকে ঢাকাগামী একটি বাসে ডাকাতিকালে দুই তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটিয়েছে ডাকাতরা।
গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও জোনের ডিসি ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, ডাকাতরা ধর্ষণ ও হত্যার কথা স্বীকার করেছে। কয়েকটি ঘটনায় বাসের লোকজন জড়িত থাকার প্রমাণও মিলেছে। ডাকাতদের ধরতে গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম মাঠে কাজ করছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মহানগরের আশপাশের হাইওয়ে বিশেষ করে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক, ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিভিন্ন এলাকা রাতে অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ। মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর স্বল্পতার কারণে বেশিরভাগ ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। আর জেলা পুলিশের সঙ্গে হাইওয়ে পুলিশের সমন্বয়হীনতায় ভুক্তভোগীরা প্রতিকার পাচ্ছে না। ভুক্তভোগীদের মতে, মহাসড়কে ডাকাতি রুখতে হাইওয়ে পুলিশকে আরও গুরুত্বের সঙ্গে তৎপরতা বাড়াতে হবে।
পরিবহণ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের আব্দুল্লাহপুর-টঙ্গী থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার অংশে যানজটের মধ্যে প্রায় রাতে পরিবহণে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৬-৭টি ডাকাত গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। মাইক্রোবাসে যাত্রী তুলেও তারা ডাকাতি করে।এ মহাসড়কের চান্দিনা, ভবেরচর ও সোনারগাঁ অংশে এবং ফেনীর লালপুর থেকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা পর্যন্ত বিভিন্ন পয়েন্টে বেশিরভাগ ডাকাতির ঘটনা ঘটে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ভৈরবের কালিকাপ্রাসাদ থেকে কুলিয়ারচরের নোয়াগাঁও ছয়সূতি, দারিয়াকান্দি থেকে বাজরার মাঝামাঝি এলাকায় মালবাহী ট্রাক-কাভার্ডভ্যানে বেশি ডাকাতির ঘটনা ঘটে।একইসঙ্গে ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা সিলেটসহ অন্যসব অঞ্চলের মহাসড়কেও ডাকাতি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।
ডাকাত গ্রুপ: পুলিশের একটি সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় মহাসড়কে ডাকাতিতে ২৫টির বেশি ডাকাত গ্রুপ জড়িত।এরমধ্যে ঢাকা ও আশপাশের মহাসড়কে ১২টির বেশি গ্রুপ সক্রিয়। মহাসড়কের ডাকাত গ্রুপগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- দিলীপ ওরফে সোহেল গ্রুপ, আবু জাফর গ্রুপ, মনু গ্রুপ, সাতক্ষীরা বিপ্লব গ্রুপ, বরিশাইল্যা বিল্লাল গ্রুপ, কুমিল্লা গ্রুপ, ময়মনসিংহ গ্রুপ, হুমায়ুন গ্রুপ, হীরা গ্রুপ, চিটাগাইংগ্যা নুরু গ্রুপ, রহিম গ্রুপ, শহিদ গ্রুপ, সিদ্দিক গ্রুপ, জহির গ্রুপ, ইসমাইল গ্রুপ, আজম গ্রুপ, হাবিব গ্রুপ, মোখছেদ গ্রুপ ও সরোয়ার গ্রুপ।
প্রতিটি গ্রুপে ১২ থেকে ২০ জন ডাকাত রয়েছে। একেকটি গ্রুপে শতাধিক অস্ত্রধারী সদস্য রয়েছে। তাদের কাছে পিস্তল, রিভলভার ও চাইনিজ কুড়ালের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের দেশি অস্ত্রও থাকে। ডাকাতি করতে গিয়ে কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে তাকে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করে অন্যরা।
ডাকাতির ছয়টি কৌশল : ডাকাত চক্রের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে-ডাকাতি করতে গিয়ে তারা ছয়টি কৌশল অবলম্বন করে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-যাত্রীবেশে বাসে উঠে ডাকাতি, রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে গাড়ি আটকে ডাকাতি, প্রাইভেট কারে তুলে জিম্মি করে ডাকাতি, মহাসড়কে চলন্ত গাড়ির সামনের গ্লাসে ডিম ছুড়ে মারা, ঢিল মারা, কলাগাছে কাপড় পেছিয়ে লাশের মতো বানিয়ে রাস্তায় ফেলে গাড়ি আটকিয়ে ডাকাতি।
ডাকাতি বন্ধে উদ্যোগ : ২০ জানুয়ারির ডাকাতির ঘটনায় কোনো থানা মামলা না নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এরপর পুলিশ সদর দপ্তর থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশনায় বলা হয়-যে থানা এলাকায় ডাকাতির ঘটনা শুরু সেই থানাকে মামলা নিতে হবে। এছাড়া পুলিশের পক্ষ থেকে মহাসড়কের নিরাপত্তায় অন্তত দেড় ডজন সুপারিশ করা হয়।
মহাসড়কে ডাকাতি বন্ধে করণীয় নিয়ে সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তর, হাইওয়ে পুলিশ, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এবং ঢাকা রেঞ্জ পুলিশ একাধিক বৈঠক করেছে।
বৈঠকগুলোতে উপস্থিত থাকা দুজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, হাইওয়ে পুলিশের প্যাট্রলিং বাড়ানো, বাসগুলোতে জিপিএস ট্রেকার এবং আইপি ক্যামেরা বসিয়ে মনিটরিং করা, যাত্রীদের এনআইডি এবং মোবাইল ফোন নম্বর সংরক্ষণ, দূরপাল্লার বাসে যাত্রীদের ছবি তুলে রাখা, বাসের রুট পারমিট চেক করা, ডাকাতদের ডাটাবেজ তৈরি করা, এক রুটের বাস অন্য রুটে দেখলেই চেক করাসহ ১৮টি সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া বাসে ডাকাতি ঠেকাতে নতুন এক প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ।