বিজ্ঞাপন
জি ভয়েস ডেস্ক : সিলেটের বিয়ানীবাজারের বাসিন্দা মো. আমিনুর রহমান। বয়স ১৯ হলেও পাননি জাতীয় পরিচয়পত্র। জন্মনিবন্ধন আর স্থানীয় চেয়ারম্যানের নাগরিকত্ব সনদ দিয়ে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন গত আগস্টে। তবে প্রথমেই জাতীয় পরিচয়পত্র লাগবে বলে আবেদন ফিরিয়ে দেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। এরপর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে ফের আবেদন করেন জাতীয় পরিচয়পত্রের কম্পিউটার কপিসহ। এবারো ফলাফল একই। বলে দেয়া হয় অভিভাবকসহ এসে জমা দিতে হবে। দুদিন পর অভিভাবকসহ আবারো পাসপোর্ট অফিসে আসেন তিনি। তবে এবারো ব্যর্থ হন আবেদন জমা দিতে। এবারের কারণ, চালান জমা দেয়ার দুই মাস হয়ে গেছে, ফের চালান জমা দিতে হবে। আমিনুর রহমান বলেন, আমার পাসপোর্ট না হওয়ার একমাত্র কারণ হলো আমি ‘মার্কা’ কিনিনি। পাসপোর্ট আবেদন জমা দিতে হলে আগে ‘মার্কা’ কিনতে হয়।
আমিনুর রহমানের মতো এমন ভুক্তভোগীর সংখ্যা অগণিত। বিশেষ কেউ নয়- ছাত্র হোক কিংবা পেশাজীবী, বেকার হোক কিংবা প্রবাসীশ্রমিক- ‘মার্কা’ ছাড়া সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে গেলেই বিপদ আর হয়রানি। পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতির খবর নতুন নয়। কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতার কাছে একরকম জিম্মি হয়ে আছেন এ অঞ্চলের লাখো সেবাপ্রত্যাশী। দুর্নীতিকে যেন একপ্রকার ‘শৈল্পিক’ রূপ দেয়া হয়েছে এখানে।
এমন ‘মার্কা’ প্রথাসহ বেশ কিছু অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধানে নামে ভোরর কাগজ। মোরশেদা আক্তার নামের এক পাসপোর্টপ্রত্যাশীর সঙ্গে আলাপ করে তাকে দিয়ে পাসপোর্ট আবেদন জমা দিতে দেয়া হয়। যথারীতি আবেদন ফেরত আসে, স্থায়ী ঠিকানায় উল্লেখিত জেলায় গিয়ে জমা দিতে বলা হয়। তবে ভুগতে হয়নি খুব। লাইনের পাশেরই এক ভদ্রলোক এসে জানতে চান কী সমস্যা? সমস্যার কথা বললে অনেকটা ধমকের সুরেই বলে ওঠেন- ‘আপনারা শিক্ষিত মানুষ হয়ে এসব কাজ নিজে নিজে করতে যান কেন? জানেন না মার্কা ছাড়া আবেদন জমা নেবে না?’। এ সময় ভদ্রলোকের কাছে জানতে চাওয়া হয় মার্কার ব্যাপারে।
তিনি জানান, প্রতিটি আবেদনে একটি বিশেষ চিহ্ন দেয়া থাকে দালালদের, সেটা হতে পারে কোনো ট্রাভেল এজেন্ট কিংবা কোনো ফটোকপির দোকান বা ব্যক্তি। মার্কার দাম হিসেবে ৫ বছর মেয়াদি পাসপোর্ট হলে দেড় হাজার আর ১০ বছর মেয়াদি পাসপোর্টের জন্য লাগে আড়াই হাজার।
পাঁচ বছর মেয়াদি পাসপোর্ট করতে হবে জানিয়ে তাকে দেড় হাজার টাকা দিলে সে পরদিন আসতে বলে। পরদিন এসে তার কাছ থেকে আবেদন নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা যায়, আগের আবেদনপত্রে শুধু একটি অসম্পূর্ণ ইমেইল অ্যাড্রেস (এটি এক ধরনের ‘মার্কা’) লেখা রয়েছে। এবার লাইনে দাঁড়ানো হলো। তবে এবার আর কিছুই দেখা হলো না। এক পাতা উল্টে মার্কা দেখেই আবেদন গৃহীত হলো। একই লাইনে আগের দিন যাদের বিভিন্ন কারণে ফেরত দেয়া হয়েছিল তাদেরও সবারই একই ভাষ্য। মার্কা নিয়ে গেলেই কোনো কথা ছাড়াই জমা নেয়া হচ্ছে। আর মার্কা না থাকলে আপনি যেই হোন না কেন, আবেদন জমা হবে না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব মার্কা বিতরণে জড়িত আছেন অন্তত ২০টি ট্রাভেল এজেন্ট, ফটোকপির দোকান ও ব্যক্তি। বেশ কয়েকজন দালাল ও ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, মার্কা প্রথা চালু করে সবকিছু ম্যানেজ করেন সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের সুপারিনটেন্ডেট এস এম জাকির হোসেন ও উচ্চমান সহকারী দীপক কুমার দাস। তবে তারাও সরাসরি যোগাযোগ না করে অফিসের ড্রাইভার, নাইটগার্ড ও আনসার সদস্যদের মাধ্যমে টাকার লেনদেন করেন দালালদের সঙ্গে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ট্রাভেল এজেন্টদের সংগঠন-আটাব সিলেট অঞ্চলের সাবেক সহসভাপতি আবদুল জব্বার জলিল বলেন, সিলেট পাসপোর্ট অফিসে দুর্নীতি আগেও ছিল, তবে গত দু-তিন মাস থেকে এটি মহামারি আকার ধারণ করেছে। আগে অর্ধেক ফাইল দালালদের মাধ্যমে জমা হলেও অর্ধেক সরাসরি সেবাপ্রত্যাশীরা জমা করতে পারতেন। কিন্তু এখন শতভাগ পাসপোর্টই দালালদের মাধ্যমে করতে হয়। কেউ সরাসরি নিজে জমা দিতে চাইলে তাকে অন্তত পাঁচ দফা ঘুরানো হয়। এরপরও যদি জমা নেন পাসপোর্ট পেতেও বিলম্ব হয়। আর তাই মানুষ বাধ্য হয়েই দালালের শরণাপন্ন হয়।
তবে এমন অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেন সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের সুপারিনটেন্ডেট এস এম জাকির হোসেন। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, আমি জমা কাউন্টারে বসি না, এমনকি সেখানে যাইও না। কেউ যদি আমার নাম বলে থাকে তাহলে সেটা ভুল বলেছেন। আর মার্কা প্রথার নামই তিনি শোনেনি কখনো। তবে যখন প্রতিবেদক নিজে এই কাজ প্রত্যক্ষ করেছেন বলা হয়, তখন তিনি বলেন, আমি আসলে এসব ব্যাপারে জানি না। এটা যারা জমা নেন তারা বলতে পারবেন। কারা জমা নেন জানতে চাইলে তিনি দীপক কুমার দাসের নাম উল্লেখ করেন।
এসব ব্যাপারে আলাপ করতে সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক এ কে এম মাজহারুল ইসলামের দপ্তরে গিয়ে ভিজিটিং কার্ড দিলে তিনি একঘণ্টা বসিয়ে রেখেও সাক্ষাৎ দেননি। পরে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও সাড়া দেননি।
সিলেট পাসপোর্ট অফিসে দুর্নীতি : পর্ব - ১
নিউজ: ভোরের কাগজ