বিজ্ঞাপন
জি ভয়েস ডেস্ক: ‘নাজমুল বাবা আমি দুই লাখ টাকা খরচা করে এক দেশ থেকে আরেক দেশে তোরে দেখতে গেছি। তোরে বিদেশ পাঠাইছি। আমি তো পাগল না বাবা, আমারে ছার।’
এভাবেই চিৎকার করে ছেলের হাত থেকে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছিলেন নির্যাতনের শিকার হাজী খলিল মিয়া (৬০)। হাত-পা বাঁধা এই বৃদ্ধের নিপীড়নের ভিডিও এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল। বিষয়টি এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে।
অভিযোগ রয়েছে, সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে খলিল মিয়াকে নির্যাতন করছেন তার স্ত্রী ও সন্তানরা। শুধু তাই নয়, তাকে পাগল সাজিয়ে ফরিদপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তির অভিযোগ উঠেছে।
ঘটনাটি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের বৌলগ্রামের। নির্যাতিত খলিল মিয়া মৃত নূর উদ্দিন শেখের মেজো ছেলে।
এলাকাবাসী জানান, দীর্ঘ ১২ বছর প্রবাসে ছিলেন খলিল মিয়া। সেখানে তিনি যা উপার্জন করতেন তার অর্থ পরিবারের কাছে পাঠাতেন। কিন্তু প্রবাস থেকে তিন বছর আগে দেশে ফেরেন তিনি। আসার পর তার স্ত্রী হায়াতন (৫০), দুই ছেলে নাজমুল মিয়া (২৮) ও আসিফ মিয়া এবং দুই মেয়ে রাবেয়া বেগম (২৫) ও মাহামুদা আক্তারের (২২) কাছে পাঠানো অর্থের হিসাব চান। তখন থেকেই তার ওপর চলে অমানবিক নির্যাতন। এর ধারাবাহিকতায় ১০ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) খলিল মিয়ার হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করা হয়। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বৌলগ্রামসহ এলাকার সচেতন মহল।
৫৩ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, খলিল মিয়ার স্ত্রী ও তার সন্তানরা হাত-পা বেঁধে তাকে নির্যাতন করছেন। এসময় চিৎকার করে তার এক আত্মীয়কে বাঁচানোর জন্য ডাকছিলেন। চিৎকার শুনে খলিল মিয়ার সেই আত্মীয় ঘটনাস্থলে যান।
ঘটনাটি প্রকাশ্যে আনায় বর্তমানে খলিল মিয়ার ওই আত্মীয়কেও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তাই তিনি নিজের নিরাপত্তার জন্য তার নাম প্রকাশ করতে সাংবাদিকদের অনুরোধ জানান।
ওই আত্মীয় বলেন, ‘আমি তার (খলিল মিয়া) চিৎকার শুইনা দৌড়ে ঘরের ভেতর গেছি। যাইয়া দেখি তিনি ছেলের পা ধরে বলতাছে, নাজমুল বাবা আমি দুই লাখ টাকা খরচা করে এক দেশ থেকে আরেক দেশে তোরে দেখতে গেছি। তোরে বিদেশ পাঠাইছি। আমি তো পাগল না বাবা-আমারে ছার।’
খলিল মিয়া যখন চিৎকার দিয়ে কান্না করেন তখন তার মুখে গামছা ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বলে জানান ওই আত্মীয়।
তিনি বলেন, ‘খলিল মিয়া ওই খানের সবার পায়ে ধরে কইছে আমারে ছেরে দে। এই বিষয়টা আমি আমার ভাইরে জানাইছি। ভাই আমারে কইসে পুলিশ যাইতে আছে, পুলিশ বাড়ি নিয়ে যা। আমি পুলিশ আনতে গেছি আইয়া দেখি কাকা নাই।’
এলাকাবাসীর দাবি, খলিল মিয়া সম্পূর্ণরূপে একজন সুস্থ ও ভালো মানুষ। তার পরিবারের লোকজনের আশঙ্কা খলিল মিয়ার নামে থাকা সম্পত্তি তার ভাইদের লিখে দেবেন। তাই গত শুক্রবার তাকে নির্যাতনের পর হাত-পা বেঁধে পাগল সাজিয়ে ফরিদপুরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি করেন স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা।
নির্যাতিতের ভাই তারা মিয়া বলেন, ‘আমার ভাই মালয়েশিয়া ছিল নয় বছর, তিন বছর ছিল সৌদি। বিদেশে থাকার সময় সব টাকা তার পরিবারের কাছে পাঠাইছে। পরিবারের কেউ টাকার হিসাব তাকে দিতে পারে নাই। তারপরও গত কয়েকদিন আগে আমার ভাই সম্পত্তি বেচে সাত লাখ টাকা দিছে ওদের। আবারও ওরা সম্পত্তি বেচে টাকা চায়। ওরা ভাবে হয়তো আমার ভাই আমারে সম্পত্তি লিখে দেবে। এ কারণে আমার ভাইরে বেঁধে বাঁশ দিয়া ঝুলাইতে ঝুলাইতে নিয়া গেছে। যখন মানুষ জিগাইছে কি হইছে- ওরা কইছে পাগল হয়ে গেছে। তাই তারে নিয়ে যাইতেছি। গ্রামে আরও মানুষ আছে, তাদের জিজ্ঞেস করে দেখেন, আমার ভাই পাগল না-কি।
প্রতিবেশী আকিরন বেগম বলেন, ‘জুম্মার নামাজের সময় আমি দোকানে বসাছিলাম। দেখলাম হাত-পা বাইন্দা নিয়ে যাইতেছে খলিল মিয়াকে। খলিলের স্ত্রীরে বললাম, ভাবি কি হইছে? সে কইল- উনি স্ট্রোক করছে। পাগল হয়ে গেছে। আমি তখন কইলাম উনি কোথায় পাগল? এসময় খলিল মিয়া বলে ওঠেন- আমি সুস্থ আমারে তোরা বাঁচা, সে সবার নাম ধরে ডাকতাছে। পাগল আবার এইসব কথা কয় না-কি। নামাজের সময় তাই পুরুষ মানুষ ছিল না, কেডা ওনারে বাঁচাইবে।’
প্রতিবেশী শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘খলিল মিয়ার বাড়িতে চিল্লাচিল্লির আওয়াজ আমার কানে গেছে। তখন আমি আরও কয়েকজন নিয়া ওই বাড়ি গেছি। যাইয়া দেখি দরজা আটকানো, আর জানালা খোলা। জানালা দিয়া দেখি, তার হাত-পা বাঁধা। পরে নামাজ পড়ে আইসা শুনি তাকে বাইন্দা নিয়া গেছে।’
এ বিষয়ে জানতে খলিল মিয়ার বাড়ি গেলে সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে অভিযুক্তরা দরজা বন্ধ করে দেন। পরে দরজার ওপাশ থেকে আসিফের স্ত্রী পরিচয়ে একজন বলেন, ‘আপনাদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না। আমরা দরজা খুললে আশপাশের মানুষ আমাদের মেরে ফেলবে। ভেতরে ছোট বাচ্চা আছে। আপনারা এখান থেকে চলে যান।’
এ ব্যাপারে জানতে খালিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহ আলমের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
রাজৈর থানার অফিসার ইনচার্জ ওসি শেখ সাদিক জানান, অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র: জাগো নিউজ