বিজ্ঞাপন
ডেস্ক রিপোর্ট : কলেজে ভর্তির পর বন্ধুদের সঙ্গে একাধিকবার তাবলিগে গিয়েছিলেন সিলেটের আব্দুর রাজ্জাক। বাসায় টিভি, ল্যাপটপ কিছুই নেই। কয়েক মাস আগেই স্মার্ট ফোন কিনেছেন ২০ বছর বয়সী এ যুবক। বাসায় কাউকে টিভি দেখতে দিতেন না, গান শুনতেও মানা। মোবাইলের ইউটিউবে ধর্মীয় বিভিন্ন বক্তার ওয়াজে মগ্ন থাকতেন।
হঠাৎ একদিন বন্ধুদের সঙ্গে নিখোঁজ হন তিনি। খোঁজ নিয়ে পুলিশ জানায়, রাজ্জাক আফগানিস্তানে চলে গেছেন। বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তার আত্মীয়-স্বজন। পুলিশ নিশ্চিত করে জানায়, আব্দুর রাজ্জাক এখন আফগানিস্তানে অবস্থান করছেন।
পুলিশের বক্তব্য, কথিত ‘হিজরত’ আর ‘মুসলমানদের রক্ষার’ নামে আব্দুর রাজ্জাকের বাড়িছাড়া। বড় ভাই সালমান খান কাছে তার নিখোঁজের বিষয়টি নিশ্চিত করলেও ‘মুসলমানদের রক্ষার নামে তার আফগানযাত্রা’— কোনোভাবেই মানতে রাজি নন।
বড় ভাই সালমান জানান, গত ২৪ মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় বাসা থেকে বের হন আব্দুর রাজ্জাক। ‘দুদিন বন্ধুর বাসায় থাকব’— এমনটি বলে তিনি সিলেটের লামাবাজার ছাড়েন। সেখান থেকে যান বন্ধু ফরিদের বাসায়। ২৫ মার্চ ফরিদের বাসা থেকে নিজ বাসায় ফেরার কথা থাকলেও আর ফেরেননি রাজ্জাক।
সম্প্রতি আব্দুর রাজ্জাকের সন্ধান দিয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। সংস্থাটি বলছে, ভারত হয়ে রাজ্জাক এখন আফগানিস্তানে অবস্থান করছেন। তিনি একা নন, তার সঙ্গে আরও অনেক বাংলাদেশি যুবক আছেন। সেখানে তালেবানদের সহযোগী হিসেবে তারা কাজ করছেন।
রাজ্জাকের ভাই সালমান খান বলেন, রাজ্জাক লামাবাজারের একটি কলেজের শিক্ষার্থী। ছোটবেলা থেকেই খুব শান্তপ্রকৃতির সে। দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে নিয়মিত নামাজ আদায় করে। খুব বেশি নয়, হাতেগোনা কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে ছিল তার চলাফেরা। প্রয়োজন ছাড়া পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে কথা বলত না রাজ্জাক। এলাকায় তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। সে যে আফগানিস্তান যেতে পারে— এটা বিশ্বাস হয় না।
সালমান খান আরও বলেন, ‘২৫ মার্চ থেকে সে নিখোঁজ। অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি। শেষমেশ ১ এপ্রিল সিলেটের কোতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করি’। ওই জিডির সূত্র ধরে সালমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে সিটিটিসি। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে তারা জানায়, ‘রাজ্জাক চলে গেছে আফগানিস্তানে।’
সিটিটিসি’র পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, সম্প্রতি তারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার হওয়া কয়েকজন জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারা জানান, তাদের অনেক বন্ধু কথিত হিজরতের নামে আফগানিস্তান গেছেন। তাদের মধ্যে রাজ্জাকও রয়েছেন। রাজ্জাকের ছবি দেখে তারা বিষয়টি সিটিটিসিকে নিশ্চিত করেন।
রাজ্জাক কীভাবে আফগানিস্তানে গেল— জানতে চাইলে সিটিটিসি জানায়, প্রথমে ভারত, এরপর পাকিস্তান হয়ে তিনি আফগানিস্তান পৌঁছেছেন। হিজরতের নামে তালেবানদের সঙ্গী হয়ে যুদ্ধ করাই তার মূল উদ্দেশ্য। রাজ্জাক শুধু একাই যাননি। তার মতো আরও অনেক যুবক হিজরতের নামে গ্রুপ করে তালেবানদের ডাকে আফগানিস্তানে যাচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটিটিসি’র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অ্যাডিশনাল এসপি) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, অনেক আগে থেকেই আমরা রাজ্জাকের বিষয়ে জানতাম। তিনি আফগানিস্তান যেতে পারেন— এমনও সন্দেহ ছিল। সম্প্রতি কয়েকজন জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে আমরা বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছি যে, তিনি আফগানিস্তান গেছেন।
‘শুধু রাজ্জাক নন তার মতো আরও অনেকে বর্তমান আফগান-পরিস্থিতি নিয়ে বেশ উদ্বেলিত। তাদের মধ্যে তালেবান ফ্যান্টাসি কাজ করছে। তালেবানদের সঙ্গে তারাও বিজয়ের সঙ্গী হতে চান। এ কারণে দলে দলে সেখানে (আফগানিস্তান) যাওয়ার চেষ্টা করছেন। অনেকে সফলও হয়েছেন’— বলেন এ পুলিশ কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি তালেবানরা আফগানিস্তান যুদ্ধে অংশ নিতে মুসলিম যুবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে কিছু যুবক কথিত হিজরতের নামে ঘর ছেড়েছেন। বাংলাদেশ থেকেও গেছেন। তবে ঠিক কতজন গেছেন এ মুহূর্তে সংখ্যাটি বলা যাচ্ছে না।
সম্প্রতি তালেবানরা আফগানিস্তান যুদ্ধে অংশ নিতে মুসলিম যুবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে কিছু যুবক কথিত হিজরতের নামে ঘর ছেড়েছেন। বাংলাদেশ থেকেও গেছেন। তবে ঠিক কতজন গেছেন এ মুহূর্তে সংখ্যাটি বলা যাচ্ছে না।
রাজ্জাকের ভাইয়ের বক্তব্য অনুযায়ী, ছোট বেলা থেকেই তিনি খুবই শান্ত স্বভাবের ছিলেন। একা একা থাকতে পছন্দ করতেন। নিয়মিত নামাজও পড়তেন। কলেজ বন্ধ থাকলে বন্ধুদের সঙ্গে তাবলিগ জামাতে যেতেন। সব সময় কম কথা বলতেন। কাজ ছাড়া অতিরিক্ত কথা বলতেন না। রাজ্জাক বলতেন, ‘অতিরিক্ত কথা বলে যদি কারও মনে কষ্ট দিয়ে থাকি তাহলে তো আমি পাপ করে ফেললাম। এ কারণে কম কথা বলাই ভালো।’
বড় ভাই সালমান বলেন, ‘ফোনেও কারও সঙ্গে বেশি কথা বলত না সে। গান-বাজনা পছন্দ করত না। ঘরে কোনো দিন টিভিও কিনতে দেয়নি।’ আমাকে প্রায়ই বলত, ‘মুসলমানদের ওপর অত্যাচার করে সবাই মজা পায়। সবাই শুধু মুসলমানদের ওপর দোষ চাপায়। আমরা (মুসলমানরা) কী এতই খারাপ? পৃথিবীতে আমাদের কি কোনো দাম নেই?’ আমরাও বিষয়টি তেমন গুরুত্ব দেইনি— বলেন সালমান।
ছোট ভাইয়ের নিখোঁজ হওয়ার দিনের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, গত ২৪ মার্চ সন্ধ্যায় রাজ্জাক তার বন্ধু ফরিদের বাসায় যায়। সেখানে সে একদিন থাকবে বলে আমাদের জানায়। ফরিদ যেহেতু লামাবাজার এলাকার ভাতলিয়া মসজিদের হুজুর, মসজিদের কোয়াটারেই সে থাকে, এ কারণে বাধা দেইনি। এরপর সে আর ফিরে আসেনি।