বিজ্ঞাপন
ফাহিম আহমদ : কয়েকজন শিক্ষার্থী যখন এক সাথে বসে মোবাইল টিপতে থাকে তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তারা কি করছে। কাছে গেলেই দেখবেন তারা অনলাইন গেমসে মগ্ন। ফ্রি-ফায়ার অথবা পাবজি গেমস। যে কোন একটি গেমস তারা বসে একত্রে খেলছে। জায়গাটা বাসা-বাড়ি হোক, খেলার মাঠ হোক কিংবা হাট-বাজার।
ফ্রি-ফায়ার এবং পাবজি গেমস শিক্ষার্থীদের এমনভাবে আঁকড়ে ধরছে যেটা থেকে কোনভাবেই বের হয়ে আসা সম্ভব নয়। এমনকি গেমস খেলায় তারা মগ্ন থাকলে কেউ পাশ থেকে কথা বললেও তারা সেদিকে ধ্যান দেয় না। তাদের ধ্যানটাই হচ্ছে হাতের স্মার্ট ফোনের দিকে। কিভাবে গেমসে লেভেল বাড়ানো যায়, ডায়মন্ড কিনা যায়, সেদিকেই তাদের লক্ষ্য। শিক্ষার্থীরা কিভাবে এ ধরণের গেমসের প্রতি এতো আসক্ত হলো এর উত্তর থাকলেও সমাধান নেই। আর এতে করে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাওয়ার উপক্রম।
গোলাপগঞ্জ উপজেলার এমন কোন জায়গা নেই যে জায়গার শিক্ষার্থীরা অনলাইন গেমসের প্রতি আসক্ত নয়। শিক্ষার্থী ছাড়াও অনেক যুবকরা এ ধরণের গেমসের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাটাই শিক্ষার্থীদের গেমসের প্রতি আসক্ত হওয়ার বড় কারণ বলে মনে করছেন অনেকে। দীর্ঘদিন ধরে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকা এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাস করার প্রয়োজনে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাদের অ্যানড্রয়েড মোবাইল ফোন কিনে দিচ্ছেন। কিন্তু উপজেলার বেশির ভাগ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাস না করে গেমসের দিকে নজর দিচ্ছে বেশি। ফলে বেশির ভাগ সময় তারা ওই গেমস খেলে সময় কাটাচ্ছে। এতে দিন দিন উপজেলার বেশির ভাগ শিক্ষার্থী এসব গেমসে আসক্ত হয়ে পড়ছে।
উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় প্রতিদিন ৩-৫ জন করে শিক্ষার্থী মিলে মোবাইলে অনলাইন গেমস খেলছে এমন দৃশ্য সব সময় চোখে পড়ছে। অনেক শিক্ষার্থী বা বেকার যুবকরা তাদের বন্ধুদের সঙ্গে ওই গেমস খেলা দেখাদেখি করতে গিয়ে তারাও আসক্ত হয়ে পড়ছে। বাসায় পড়াশোনার তেমন কোন চাপ না থাকায় শিক্ষার্থীদের অনলাইন গেমসের প্রতি আসক্তি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বেশ কয়েকদিন থেকে মোবাইলে অনলাইন গেমসে আসক্ত অনেক শিক্ষার্থীর সাথে কথা হয়। তারা বেশিরভাগ স্কুল ও কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী। তারা জানান, ‘এ গেমস তাদের সবকিছু। সবকিছু বাদ দিতে পারেন তবে ফ্রি-ফায়ার, পাবজি খেলা তারা কখনো বাদ দিতে পারবেন না। দিন-রাত সব সময় তারা গেমসে মগ্ন থাকেন। অনেক সময় খাওয়া দাওয়ার সময় কোন দিকে যায় সে খোঁজও থাকে না তাদের। কখনও ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেলে বিরক্ত লাগে। অনেকে ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেলে চার্জে ফোন লাগিয়েও গেমস খেলে থাকেন।’
অনেকে জানান, হাতখরচের টাকা থেকে কিছু টাকা রেখে সেই টাকা দিয়ে মোবাইল ফোনে এমবি কিনে ফ্রি-ফায়ার এবং পাবজি অনলাইন ভিডিও গেমস খেলে থাকেন। অনেকে এমনভাবে এ গেমসে আসক্ত হয়েছে, তাতে তাদের পক্ষে এ গেমস খেলা ছেড়ে দেওয়া সম্ভব না বলে জানায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাদশ শ্রেণীতে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী জানান, ‘কলেজ বন্ধ। ভাইয়ের দোকান বসে ডিউটি করি। আর মোবাইলে গেমস খেলি।’ এমবির টাকা কোথা থেকে আসে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দোকান থেকে নেই’। মাসে কত জিবি লাগে জানতে চাইলে উত্তর আসে, প্রতি সপ্তাহে ৪০ জিবি। প্রতি মাসে হাজার টাকার এমবি কিনি।
অভিভাবকদের সাথে কথা হলে তারা বলেন, ‘অনলাইন ক্লাসের জন্য তাদেরকে অ্যানড্রয়েড ফোন কিনে দিয়েছিলাম। অনলাইন ক্লাস না করে তারা মোবাইলে গেমস খেলায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। কোনভাবেই তাদেরকে এ জায়গা থেকে ফিরানো যাচ্ছে না। এভাবে বেশ কিছুদিন চললে তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতে শেষ হয়ে যাবে। যতদিন না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হচ্ছে ততদিন তাদেরকে অনলাইন গেমস থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তারা এখন মোবাইলে এতটা আসক্ত হয়ে পড়ছে যে অনেক সময় মিথ্যা অজুহাতে টাকা নিয়ে এমবি কিনে গেমস খেলে।’
তারা আরো বলেন, পড়াশোনা তো নাই বললেই চলে। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া তো করেই না, বরং অরুচিতে ভুগছে। এভাবে আরো কিছুদিন চলতে থাকলে অধিকাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গোলাপগঞ্জ উপজেলা আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা.শাহীনুর ইসলাম শাহিন বলেন, ‘বেশি সময় মোবাইল বা ল্যাপটপ নিয়ে যারা পড়ে থাকবে, তাদের মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়া ও মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অতিরিক্ত মোবাইল আসক্তদের বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে খাবারে রুচিহীনতা এবং দৃষ্টিশক্তির সমস্যাও হতে পারে। প্রতিদিন আমরা চোখে সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে আসছে এমন রোগী পেয়ে থাকি। শিক্ষার্থীরা অনলাইন গেমসের প্রতি এমনভাবে আসক্ত হয়েছে যার থেকে তাদেরকে ফিরিয়ে আনা খুবই কষ্টসাধ্য।’
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার অভিজিৎ কুমার পাল বলেন, শিক্ষার্থীদের অনলাইন গেমসে আসক্ত হওয়ার পিছনে বড় কারণ হচ্ছে অভিভাবকদের অসচেতনতা। অভিভাবকদের সন্তানের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। সরকারি নির্দেশনা মত অনলাইন ক্লাস করা কথা থাকলেও অনেক শিক্ষার্থী এ বিষয়ে উদাসীন।
তিনি বলেন, পড়ালেখার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য চর্চা জরুরি। খেলাধুলার কোন বিকল্প নেই। তবে সব সময় মোবাইলে অনলাইন গেমসের প্রতি ঝুঁকে থাকবে এটা কোনভাবেই কাম্য নয়।