বিজ্ঞাপন
ডেস্ক রিপোর্ট : আদর্শ ও মানবতাবাদী নির্মোহ রামনাথ বিশ্বাস শুধু একজন ভূপর্যটকই নন; তিনি খ্যাতিমান লেখক, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ও সমাজসেবক। একজন বিশ্বমানের ভূপর্যটক কিংবা অভিযাত্রী হিসেবেও তিনি খ্যাত। গোটা ভারতবর্ষে এখনও তার নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে তিনি বাইসাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণ করে পাশাপাশি ৩০টি ভ্রমণ কাহিনিসহ ৫০টিরও অধিক গ্রন্থ লিখে তাক লাগিয়েছিলেন। তিনি যে সময়ে ভ্রমণে বের হয়েছিলেন, তখন বিশ্ব এত উন্নত ছিল না। লঞ্চ-স্টিমার থাকলেও এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে অনেক দিন লেগে যেত। ঠিক এই সময়ে অজপাড়াগাঁ থেকে বাইসাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণ করা ক'জনের পক্ষে সম্ভব!
৫ ফুট ৪ ইঞ্চি লম্বা চিরকুমার; কীর্তিমান সুপুরুষ রামনাথ বিশ্বাসের বুদ্ধি, সাহস আর গায়ের জোর কোনোটাতেই কম ছিল না। তিনি ১৮৯৪ সালের ১৩ জানুয়ারি হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ের বিদ্যাভূষণপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে চাকরির সন্ধানে বের হন তিনি। হবিগঞ্জের জাতীয় ভান্ডার সমিতির ম্যানেজার পদে ১৯২১ সালের মাঝামাঝি কাজে যোগদান করেন। মোটর কারখানায় চাকরির সুবাদে তিনি মোটর ও বাইসাইকেল চালনায় বিশেষ পারদর্শী হয়ে ওঠেন। শৈশব থেকেই রামনাথের ভ্রমণস্পৃহা ছিল। তাই নিজেকে কোনো শৃঙ্খলে আবদ্ধ না রেখে এক সময় ভান্ডার সমিতির কাজ ছেড়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ও তীর্থস্থান ভ্রমণ করে ১৯২৩ সালে চলে যান সিঙ্গাপুরে। সেখানে চাকরি নেন একটি চীনা খনিতে সুপারভাইজার হিসেবে। এ সময়েই তিনি গোপনে অনুশীলন সমিতিতে যোগদান করেন। এতে তিনি চাকরি থেকে বহিস্কৃত হন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে বাঙালি পল্টনের সঙ্গে তিনি মেসোপটেমিয়ায় যুদ্ধে যোগ দেন। ১৯২৪ সালে তিনি মালয়ে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর একটি চাকরিতে যোগ দেন এবং ১৯৩০ সালে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে সিঙ্গাপুরে ফিরে এসে অনেক বাঙালিকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন। ছোটবেলার স্পৃহা ও বন্ধুবান্ধবের উৎসাহ কাজে লাগিয়ে বিশ্বভ্রমণে বের হন ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই সিঙ্গাপুরের কুইন স্ট্রিটের বাঙালি মসজিদের সামনে থেকে। জনতার বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে হাফ শার্ট, হাফপ্যান্ট, মাথায় টুপি, ফ্যানিক্সের জুতা পরে মুক্ত আনন্দে সবার প্রিয় মানুষটি শুরু করলেন সাইকেলযাত্রা। সঙ্গে নিলেন এক জোড়া চটি জুতা ও দুটি চাদর। সাইকেলের ক্যারিয়ারের একটি বাক্সে সাইকেল মেরামতির সরঞ্জাম। সাইকেলের গায়ে লেখা 'রাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড, হিন্দু ট্রাভেলার।' সাইকেলে চড়ে তিনি মালয়, ইন্দোচীন, চীন, কোরিয়া, জাপান, থাইল্যান্ড, আমেরিকা, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া হয়ে কানাডায় পৌঁছেন।
১৯৩৪ সালে তিনি গ্রামে ফিরলে গ্রামবাসী বানিয়াচংয়ের ঐতিহাসিক এড়ালিয়া মাঠে এক বিশাল সংবর্ধনা সভার আয়োজন করে। ওই বছরের শেষদিকে রামনাথ বিশ্বাস দ্বিতীয়বার বিশ্বযাত্রা করেন। সেবার তিনি আফগানিস্তান, পারস্য, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, তুরস্ক, বুলগেরিয়া, যুগোস্লাভিয়া, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, জার্মানি, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স হয়ে ব্রিটেন পৌঁছেন। এ যাত্রায় তার শরীর ভেঙে গিয়েছিল। ১৯৩৬ সালে তিনি লন্ডন থেকে জাহাজে পোর্ট সৈয়দ হয়ে মুম্বাই প্রত্যাবর্তন করেন। সুস্থ হয়ে তিনি শান্তিনিকেতনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে যান। কবিগুরু তাকে আশীর্বাদ করেন এবং কয়েকটি বাক্যও লিখে দেন।
রামনাথ তৃতীয়বার বিশ্বযাত্রা করেন ১৯৩৮ সালে। সেবার তিনি আফ্রিকা মহাদেশে পাড়ি দেন। কেনিয়া, উগান্ডা, নায়াসাল্যান্ড, রোডেসিয়া হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছেন। সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যান। ১৯৪০ সালে দেশের বাড়িতে ফিরে আসেন। তিনি ভ্রমণ করেন প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার বর্গমাইল। ইতোমধ্যে শুরু হয় ভারত বিভক্তি আন্দোলন। ওই সময় তিনি পাড়ি জমান ভারতে। ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং লেখালেখির সঙ্গে হোমিও চিকিৎসা দিতে থাকেন। তার বইগুলোতে রয়েছে তরুণ প্রজন্মের অনেক শিক্ষণীয় বিষয়। ১৯৫৫ সালের ১ নভেম্বর তিনি পরলোকগমন করেন। যে মানুষটি বাঙালি সমাজের জন্য এত সম্মান বয়ে আনলেন, তার বাড়িটি আজ ভুয়া কাগজ তৈরি করে জনৈক প্রভাবশালী দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছে। এলাকাবাসীর দাবি, তার বাড়িটি উদ্ধার করে সংরক্ষণ ও পর্যটন কেন্দ্র করা হোক।
তথ্য সূত্রে : সমকাল