Advertisement (Custom)

বিজ্ঞাপন
প্রকাশিত: রবিবার, ২ মে, ২০২১
সর্বশেষ সংষ্করণ 2021-05-02T07:40:19Z
লিড নিউজসিলেট

সিলেটে বইখাতা ফেলে কাজে ঝুঁকছে শিক্ষার্থীরা

বিজ্ঞাপন

ডেস্ক রিপোর্ট : সিলেট নগরীর তপোবন এলাকার বাসিন্দা স্বপ্না আক্তার। পাঠানটুলা দ্বিপাক্ষিক স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী সে। করোনাসঙ্কটে কারণে বাবা মুশাহিদ মিয়া বেকার হয়ে পড়েছেন। মা নূরজাহান বেগম গৃহিনী। পরিবারে কারো রোজগার নেই। তাই এই রমজানের জন্য স্বপ্নাকে এক বাসায় গৃহকর্মীর কাজে দিয়েছে তার পরিবার। 

করোনার কারণে স্কুল বন্ধ। তার উপর বাবা বেকার। তাই পরিবারের প্রয়োজনে বাধ্য হয়েই গৃহকর্মীর কাজ করতে হচ্ছে তাকে। আর লেখাপড়ায় ফিরতে পারবে কি না এনিয়ে শঙ্কায় স্বপ্না।

সিলেট আইডিয়াল স্কুলের ৭ম শ্রেণির ছাত্র রায়হান আহমদ লালন। নগরীর নেহারিপাড়া এলাকার জিলু মিয়া ও জাহেদা বেগমের ছেলে। বাবা দিনমজুর। করোনার কারণে নিয়মিত কাজ পান না। পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল না। তাই এই করোনাকালে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকার কারণে একটি সুপারশপের মালামাল বহন করার কাজ করে সে। 

রায়হানের ইচ্ছে ছিলো পড়ালেখা করে বড় হওয়ার। তবে দীর্ঘদিন কাজ করতে করতে এখন লেখাপড়া থেকে মন উঠে গেছে প্রায়। তাই করোনায় বন্ধ হওয়া স্কুলে আবার ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তায় রায়হানও।    

করোনা সংক্রমণের প্রভাব পড়েছে দেশের সকল খাতেই। তবে সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে পড়েছে শিক্ষাখাত। এক বছরের অধিক সময় ধরে বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পরীক্ষা-ভর্তি কার্যক্রম সবকিছুই বন্ধ। এতে বিপাকে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। স্বপ্না-রায়হানদের মতো অনেক শিক্ষার্থীই এখন বইখাতা ফেলে ঢুকে পড়ছে কাজে। তাদের পুনরায় শিক্ষাজীবনে ফেরা নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়।

এই সঙ্কটকালে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর অনেক শিক্ষার্থীদের অনিচ্ছা স্বত্বেও সংসারের দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। কেউ মাস্ক বিক্রি করছে, কেউ গৃহকর্মীর কাজ করছে, কেউ মুদি দোকানে কাজ করছে, কেউবা আবার দিনমজুরের কাজ করছে। 

সিলেট নগরের বিভিন্ন এলাকায় গেলেও এখন আগের তুলনায় অধিক পরিমাণে শিশু শ্রমিকের দেখা মেলে। এমনকি নগরের ফুটপাতে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করতেও শিশু-কিশোরদের দেখা যায়।

স্কুল বন্ধের সুযোগে নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশু-কিশোর-তরুণরা কর্মমুখী হয়ে পড়ছে। করোনা পরবর্তী সময়ে এই শিশুদের স্কুলে ফেরা নিয়েও রয়েছে শঙ্কা। কর্মমুখী হওয়ার পাশাপাশি বাল্যবিয়ের কারণেও অনেক মেয়ে শিশু শিক্ষা থেকে ঝরে পড়বে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্কুল থেকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার পেছনে অন্যতম কারণ হবে দরিদ্রতা ও বাল্যবিয়ে। বিশেষ করে শহরের বস্তিবাসী হাওর ও চর অঞ্চলের শিশুরাই বেশি ঝরে পড়বে বলে মনে করছেন তারা।

সিলেটের দক্ষিণ সুরমা এলাকার কাউসার। দক্ষিণ সুরমার একটি বস্তিতে সে তার মায়ের সাথে থাকে। ৫ম শ্রেণির ছাত্র এখন হুমায়ন রশিদ চত্বরে মাস্ক বিক্রি করে। দারিদ্রতায় জর্জরিত সংসারে মায়ের একার আয়ে চলে না। তাই বাধ্য হয়েই মাস্ক বিক্রি করতে রাস্তায় নেমেছে সে। কাউসারের মত আরও তিন থেকে চার জন শিশু আছে যারা করোনার কারণে স্কুল বন্ধ হওয়া মাস্ক বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছে। 

২০১৯ সালের প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭.৯ শতাংশ আর মাধ্যমিকে এ হার ছিল ৩৭.৬২ শতাংশ। ২০২১ সালে ঝরে পড়ার হার আরও অনেক বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন শিক্ষাবিদরা। কারণ করোনার কারণে দারিদ্র্য আগের চেয়ে বেড়েছে, পাশাপাশি বেড়েছে বাল্যবিয়ের হারও। 

চলতি বছর পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এক যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে তৈরি হওয়া পরিস্থিতির প্রভাবে শহরের নিম্নআয়ের মানুষের আয় কমেছে ৮২ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলের নিন্মআয়ের মানুষের আয় কমেছে ৭৯ শতাংশ।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, করোনা পরবর্তী স্কুল শুরু হলে ক্লাসে আগের মতো শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি থাকবে না। আগের বছরগুলোর চেয়ে করোনা পরবর্তী ঝরে পড়ার হার বাড়বে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা করোনাকালে বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়েছে, তাদের একটা বড় অংশ স্কুলবিমুখ হয়ে পড়বে। এবং এর প্রভাব বেশি পড়বে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক লেভেলের শিক্ষার্থীদের উপর। 

চলতি বছর জানুয়ারিতে প্রকাশিত এডুকেশন ওয়াচের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিকে ৩৮ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার পরও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যেতে পারে। ২০ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে এবং ৮.৭ শতাংশ মনে করেন, শিক্ষার্থীরা শিশুশ্রমে নিযুক্ত হতে পারে। মাধ্যমিকে ৪১.২ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, বেশি শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতে পারে। ২৯ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে। ৪০ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অনিয়মিত উপস্থিতির হার বাড়বে এবং ২৫ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে। ৪৭ শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার বাড়বে, ৩৩.৩ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়া বাড়বে এবং ২০ শতাংশ মনে করেন, অনেকেই শিশুশ্রমে যুক্ত হতে পারে। ৬৪ শতাংশ এনজিও কর্মকর্তা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার ও ঝরে পড়া বেড়ে যাবে।

সিলেটের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় লিডিং ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগের প্রধান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. মোস্তাক আহমাদ দীন বলেন, করোনা মহামারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে সব লেভেলের শিক্ষার্থীদের উপর মানসিক প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুদের উপর এর প্রভার বেশি পড়বে। কারণ তাদের অভিভাবকদের বেশিরভাগেরই আয় উপার্জন কমে যাবে। তাই বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক লেভেলের অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পরবে। 

তিনি বলেন, যে শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে কর্মমুখী হয়ে পড়েছে তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনা অনেকে কষ্টকর হবে। কারণ দীর্ঘদিন কাজের সাথে যুক্ত থাকায় তাদের শারীরিক ও মানসিক অনেক পরিবর্তন ঘটবে।     

ড. মোস্তাক আহমাদ দীন আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের স্কুলমূখী করতে সরকার বিভিন্ন উপবৃত্তি দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের এর বাইরে শিশুদের মানসিক অবস্থা নিয়েও চিন্তা করতে হবে। কারণ দীর্ঘদিন গৃহবন্দি থাকা ও কাজে জড়িয়ে পড়ার কারণে প্রায় সব শিশুর মানসিক পরিবর্তন ঘটবে। তাই করোনা পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের মানসিক সুস্থতার জন্য প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মনোবিদদের নিয়ে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এবং এটা সরকারের পক্ষ থেকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এব্যাপারে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ও এনজিওকেও সাহায্য করতে হবে। 

তিনি বলেন, সরকারকে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলছি এই কারণে, বাচ্চাদের মানসিক সুস্থতার জন্য হয়তো বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যক্তিগতভাবে এই উদ্যোগ নেবে। কিন্তু এর সুফল সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীরা পাবে না। তাই যেন সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এই সেবা পায় সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য শিশুদের মানসিক সুস্থতার জন্য সরকারিভাবে এই উদ্যোগ নিতে হবে।        

সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আ. ন. ম বদরুদ্দোজা বলেন, করোনা মহামারীর সঙ্কট সারা বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান। তাই এখন চাইলেও স্কুল খোলা যাবে না। করোনা পরবর্তী শিক্ষা ব্যবস্থায় হয়তো কিছু সঙ্কট আসবে। সেই সঙ্কট কাটিয়ে উঠার জন্যও সরকার কাজ করবে। শিশু যেন স্কুলবিমুখ না হয় সেজন্য সরকার বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থীদের পরিবারকে সাহায্য করছে। শিক্ষার্থীদের মায়ের মোবাইলে সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষার উপবৃত্তির টাকা পৌঁছে দিচ্ছে ‘নগদ’ একাউন্টের মাধ্যমে।  

সিলেটের সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার নাজমা বেগম বলেন, করোনার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার সংখ্যা বাড়তে পারে। এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে শিক্ষকরা আছেন তাদের দায়িত্ব নিতে হবে। পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকেও হয়তো চেষ্টা করা হবে। 

তিনি বলেন, আমি মনে করি করোনা পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানমূখী করতে বিশেষ বৃত্তি, বা আকর্ষণীয় কোনো পুরস্কারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে করে করোনা পরবর্তী যে শিশুরা স্কুলবিমুখ হবে তাদের ফিরিয়ে আনা যাবে।
বিজ্ঞাপন

জনপ্রিয় সংবাদ