বিজ্ঞাপন
ডেস্ক রিপোর্ট : বাংলাদেশ ভারত সীমান্তবর্তী খুবই পরিচিত এক স্থান তিন বিঘা করিডোর। এটি একটি স্বতন্ত্র ভূমি যা ভারতের মালিকানাধীন। যা মাত্র তিন বিঘা জায়গার মধ্যে অবস্থিত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার মেঘলিগঞ্জ মহকুমা ও বাংলাদেশের লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার সীমান্তে ঘেঁষে এর অবস্থান। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহলে যাতায়াতের সুবিধার্থে এটি বাংলাদেশকে ইজারার মাধ্যমে দেয়া হয়।
(+) চিহ্ন রাস্তা দিয়ে দুই দেশের নাগরিকেরা চলাচল করে। এছাড়াও (+) চিহ্নের রাস্তার মাঝখানে দ্বায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ ও ভারতের বিজিবি ও বিএসএফ জওয়ানেরা। দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এনক্লেভ। যাকে বাংলায় ছিটমহলও বলা হয় এবং যার লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলায়। মোট ১৮.৬১ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই গ্রামে প্রায় ১৭ হাজার বাংলাদেশির বসবাস এবং ৮০ শতাংশ মুসলমান।
১৯৭৪ সালের ১৬ মে ইন্দিরা গান্ধী-শেখ মুজিবুর রহমান চুক্তি অনুসারে ভারত ও বাংলাদেশ তিন বিঘা করিডোর দক্ষিণ বেরুবাড়ীর সার্বভৌমত্ব পরস্পরের কাছে হস্তান্তর করে। যার আয়তন ১৭৮ বাই ৮৫ মিটার বা ৫৮৪ ফুট × ২৭৯ ফুট ও ৭.৩৯ বর্গ কিলোমিটার বা ২.৮৫ বর্গমাইল। এরফলে উভয়দেশেই তাদের ছিটমহলে যথাক্রমে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ও দক্ষিণ বেরুবাড়ীর যাতায়াত সুবিধা তৈরি হয়। এই চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ সরকার সঙ্গে সঙ্গেই দক্ষিণ বেরুবাড়ী ভারতের কাছে হস্তান্তর করে যদিও ভারত তিন বিঘা করিডোর বাংলাদেশের কাছে রাজনৈতিক কারণে হস্তান্তর করেনি। কারণ এটি হস্তান্তরে ভারতের সাংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন ছিল।
পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের অনেক বিরোধিতার পর ২০১১ সালে ভারত পূর্ণভাবে এটি বাংলাদেশকে দেয়ার বদলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ইজারা হিসাবে দেয়। শর্ত ছিল যে, একই সময়ে দক্ষিণ বেরুবাড়ি ভারতের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। ১২ নং দক্ষিণ বেরুবাড়ী ইউনিয়নের মোট আয়তন ২২.৫৮ বর্গকিলোমিটার (৮.৭২ বর্গমাইল)। যার ১১.২৯ বর্গকিলোমিটার বা ৪.৩৬ বর্গমাইল পায় বাংলাদেশ। এছাড়াও পূর্বের ভাগ অনুসারে কোচবিহারের চারটি ছিটমহল বাংলাদেশে পড়ে। যার আয়তন ৬.৮৪ বর্গকিলোমিটার বা ২.৬৪ বর্গমাইল। এভাবে মোট আয়তন দাঁড়ায় ১৮.১৩ বর্গকিলোমিটার (৭.০০ বর্গমাইল)। যা বাংলাদেশে স্থানান্তর হওয়ার কথা ছিল।
বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত ঘেঁষে এই তিন বিঘার অবস্থান
১৯৬৭ সালের হিসাব অনুযায়ী এই ভূখন্ডগুলোর মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশই ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের ছিটমহল দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ভারতে হস্তান্তরের কথা ছিল। যার মোট আয়তন ১৮.৬৮ বর্গকিলোমিটার (৭.২১ বর্গমাইল) ও ১৯৬৭ সালের হিসাব অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ ছিল মুসলমান। যদি এই হস্তান্তর সফল হতো তাহলে এটি জাতিগত দাঙ্গা সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকত। ফলে তখন বেরুবাড়ীর জনগণ এই হস্তান্তরের বিরোধিতা করে বসে।
এরপর ১৯৭১ সালে ভারত বাংলাদেশকে প্রস্তাব দেয় বেরুবাড়ীর অর্ধাংশ ভারতের অধীন থাকবে এবং দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা বাংলাদেশেই থাকবে। এই চুক্তি অনুসারে ভারত দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাবাসীর বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য একটি তিন বিঘা আয়তনের জায়গা ইজারা হিসেবে দেয়। এটি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল এবং তিন বিঘার চারপাশে সতর্কতার সঙ্গে বেষ্টনীও দেয়া হয়। যা ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা-মুজিবর চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত ১.১৪ ধারা অনুসারে বেরুবাড়ী বিরোধের অবসান ঘটে।
চুক্তি অনুসারে, "ভারত দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণাংশের অর্ধেক নিয়ন্ত্রণ করবে যার আনুমানিক আয়তন ৬.৮ বর্গকিলোমিটার (২.৬৪ বর্গমাইল) এবং এর বিনিময়ে বাংলাদেশ দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা নিয়ন্ত্রণ করবে। ভারত দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা বাসীদের বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ১৭৮ বাই ৮৫ মিটার (৫৮৪ ফু × ২৭৯ ফু) আয়তনের একটি ভূমি বাংলাদেশকে ইজারা হিসেবে দেবে।
তিন বিঘা নামের উৎপত্তিও বাংলা থেকেই। বাংলা আয়তন পরিমাপের একটি একক বিঘা থেকে তিন বিঘা নামের উৎপত্তি, ভূমিটির মোট আয়তন ১ হাজার ৫০০ থেকে ৬ হাজার ৭৭১ বর্গমিটার (১৬ হাজার ১৫০ থেকে ৭২ হাজার ৮৮০ বর্গফুট) যা তিন বিঘা পরিমাপের সমান। তিস্তা পাড়ের এই গ্রামের চারপাশেই হলো ভারতীয় ভুখন্ড এবং বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে এই ছিটমহল প্রায় ২০০ মিটার দূরে। আর এই ১৭৮ মি. দৈর্ঘ্য আর ৮৫ মি. প্রস্থের তিন বিঘা করিডোরই হচ্ছে দহগ্রামে যাবার একমাত্র পথ।
পূর্বে করিডোরটি দিনের ১২ ঘন্টা সময়ের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হত, এতে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার অধিবাসীদের কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হত কারণ সেসময় সেখানে কোন হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। সর্বশেষ গত ৬ সেপ্টেম্বর ২০১১ খ্রি. তারিখে ঢাকাতে অনুষ্ঠিত হাসিনা-মনমোহন বৈঠকে স্বাক্ষরিত চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশীদের যাতায়াতের জন্য তিন বিঘা করিডোর ২৪ ঘন্টা খোলা রাখা হচ্ছে। দিনে দিনে এই তিন বিঘা করিডোর রুপান্তরিত হচ্ছে এক পর্যটন কেন্দ্রে।
২০১১ সালের ১৯শে অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে করিডোরটি উন্মুক্ত ঘোষণা করা হয়। ২০১১ সালের পূর্বে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাতে কোনো হাসপাতাল বা কলেজ ছিল না। ২০১১ সালের ১৯শে অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দহগ্রামে একটি দশ শয্যার হাসপাতাল ও দহগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের উদ্বোধন করেন। দহগ্রাম-আংগরপোতা গ্রামটি বেশি বড় নয়। তিস্তার ওপারেই ভারতীয় ভূখন্ড দেখতে পাবেন। দুই দেশের মানুষই এখানে একই নদী ব্যবহার করছে শান্তিপুর্ণভাবে।
যেভাবে যাবেন : ঢাকা/রংপুর/জেলা সদর লালমনিরহাট থেকে সরাসরি বাস যোগে পাটগ্রামে আসা যায়। এছাড়া ও রংপুর/লালমনিরহাট থেকে প্রতিদিন ০৫ টি ট্রেনে পাটগ্রামে আসা যায়। পাটগ্রাম সদর থেকে দহগ্রাম তিন বিঘা করিডোরের দুরত্ব ০৯ কি:মি:। পাটগ্রাম থেকে সবসময়ে রিকশা/টেম্পু যোগে তিন বিঘা করিডোরে যাওয়া যায়।