বিজ্ঞাপন
ডেস্ক রিপোর্ট: সর্বাত্মক লকডাউনে বন্ধ গণপরিবহণ। তাতে কী! সরকারের সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সিলেট থেকে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০টি মাইক্রোবাস যাত্রী নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এনা, হানিফ এবং শ্যামলী এ তিন পরিবহণের নামে চলে এসব গাড়ি। যার বিনিময়ে দৈনিক ওঠে আড়াই লক্ষাধিক টাকা চাঁদা। এ টাকা যায় গুটিকয়েক শ্রমিক নেতার পকেটে। আর লকডাউন বাস্তবায়নে বাংলাদেশ পুলিশের আইজিপির কড়াকড়ি নির্দেশনা থাকলেও সিলেট থেকে ঢাকা পর্যন্ত যেতে পথে পথে পুলিশ নিচ্ছে চাঁদা। এই চাঁদার বিনিময়ে মিলে চেকপোস্ট পার হওয়ার সুযোগ।
সোমবার (১৯ এপ্রিল) রাত ৮টার দিকে সিলেটের কদমতলী কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে আজব দৃশ্য। রীতিমত হাঁকডাক করে মাইক্রোবাসে ওঠানো হচ্ছে যাত্রী। এ সময় দেখা যায়, বাস টার্মিনালে এনা পরিবহনের সামনে বেঞ্চ নিয়ে বসে আছেন ৫ জন লোক। তাদের পাশে ২টি মাইক্রোবাস দাঁড় করানো (ঢাকা মেট্রো-চ ১৪-১০৪১ এবং ঢাকা মেট্রো-চ ১৯-১২৩৮)। কিছু সময় পর পর যাত্রীরা এসে যাচ্ছেন কাউন্টারের দিকে। ভেতরে ভাড়ার টাকা পরিশোধ করে এসে উঠছেন গাড়িতে। ১০ জন যাত্রী হলেই ছাড়ছে গাড়ি। ঘণ্টাখানেক সময়ের মধ্যেই ছেড়ে যায় গাড়ি দু’টি।
এবার আরেকটু সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখা মিলে আছমা ম্যানশনে হানিফ কাউন্টারের সামনে ৪টি মাইক্রোবাস দাঁড়ানো। সবগুলোতেই একের পর এক যাত্রী উঠতে শুরু করেছেন। টার্মিনাল থেকে এবার রেলস্টেশনের দিকে এগোলে স্টেশনের গেটেই শ্যামলী কাউন্টারের সামনে আরও ২টি মাইক্রোবাসে যাত্রী উঠাতে দেখা যায়। যাত্রীরা পরিচিত এসব পরিবহণের কাউন্টারে এসে রাতে গাড়ি যাবে কি না জানতে চাইলে ‘বড় গাড়ির বিকল্প মাইক্রোবাস’ রাখা হয়েছে জানিয়ে যাত্রীদের ওঠানো হয় গাড়িতে। এভাবে এনা পরিবহণের সামনে থেকে ১০ থেকে ১৫টি গাড়ি এবং অন্যান্য পরিবহণের নামে আরও অন্তত ৩৫ থেকে ৪০টি গাড়ি ছেড়ে যায়।
অভিযোগ রয়েছে, এনা পরিবহণের নামে সকল গাড়ি ছাড়ে সিলেট জেলা সড়ক পরিবহণের সাবেক সভাপতি ফলিক আহমদ সেলিমের নির্দেশে। আর বাকি গাড়িগুলো চলে বর্তমান সভাপতি ময়নুল ইসলামের নির্দেশে। বিনিময়ে তারা গাড়িপ্রতি আদায় করেন ১ হাজার টাকা। আর যাত্রীদের কাছ থেকে জনপ্রতি আদায় করা হয় ২ হাজার টাকা করে ভাড়া। যার মধ্যে ১ হাজার ৫০০ টাকা পান গাড়ির চালক আর ৫০০ টাকা করে রাখা হয় শ্রমিক চাঁদা হিসেবে। সে হিসেবে গাড়িপ্রতি চাঁদা ওঠে ৫ হাজার টাকা। এই চাঁদাতেই শেষ নয়, মাইক্রোবাসের চালককে পথে পথে দিতে হয় পুলিশের চাঁদা। সিলেট থেকে বের হয়েই পুলিশের চাঁদা শুরু দক্ষিণ সুরমার লালাবাজার এলাকার চেকপোস্ট থেকে। লালাবাজার ৩০০ টাকা করে দিতে হয় পুলিশকে। এরপর ঢাকা পর্যন্ত একে একে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন পরিমাণ চাঁদা দিয়ে তবেই গাড়ি পৌঁছায় গন্তব্যে।
পুলিশকে চাঁদা দিয়ে এসব গাড়ি চলাচলের ব্যাপারে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) বি এম আশরাফ উল্যাহ তাহের বলেন, ‘কোনো অবস্থাতেই এমন হওয়ার কথা না। জায়গায় জায়গায় আমাদের চেকপোস্ট আছে। তবুও এমন হয়ে থাকলে আমি অবশ্যই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করে ব্যবস্থা নেব।’
আর সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমি সকল জায়গায় খবর নিচ্ছি। আপাতত কোনো গাড়ি যাতে এভাবে চলতে না পারে সে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
অপর একটি সূত্র জানায়, প্রতিদিন অন্তত ৬০ থেকে ৭০টি গাড়ি ছেড়ে যায় টার্মিনাল এলাকা থেকে। প্রতিটি গাড়িতে ১০ জন করে যাত্রী বহন করা হয়। সে হিসেবে যাত্রীপ্রতি ৫০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হলে দৈনিক কমপক্ষে আড়াই লক্ষাধিক টাকা চাঁদা আদায় হয়। গত কয়েকদিন মিলে এর মোট হিসেব অন্তত ১০ লক্ষাধিক টাকা। আর গাড়িপ্রতি ১ হাজার করে চাঁদা পেলে দৈনিক অন্তত ৪০ হাজার টাকা ঢুকে শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতির পকেটে।
তবে চাঁদার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন সিলেট জেলা সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ময়নুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমি কোনো চাঁদা পাই না। শ্রমিকরা অসহায়। তাই কিছু শ্রমিক মিলে কয়েকটি গাড়ি ছাড়ে। বিদেশযাত্রী যারা, তাদেরকে নেওয়া হয়। বিনিময়ে তারা পুলিশকে কিছু টাকা দেন পথে পথে। তবে এনা পরিবহণের সামনে থেকে হয়তো কিছু গাড়ি ছেড়ে যায়। তারা সাধারণ যাত্রী নিতে পারে। অতীতেও তারা তা করেছে।’
শ্রমিক ইউনিয়নের এ সভাপতি আরও বলেন, ‘লকডাউনে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলে। কিন্তু আমাদের বাস-গাড়ি বন্ধ। আমাদের শ্রমিকরা খাবে কী করে? তাই তারা হয়তো টুকটাক কিছু করে থাকতে পারে।’
এদিকে, সোমবার রাতে গাড়িগুলো যাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা গেছে কৌশলে তাদের নাম জানার চেষ্টা করা হলে জানা যায়, এনা পরিবহণের নামে যেসব গাড়ি ছেড়ে যায় সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন গিয়াস, মুজিব, মুনিম, সাদেক এবং দুলাল। আছমা ম্যানশনের সামনে হানিফ পরিবহনের নামে ছেড়ে যাওয়া গাড়িগুলোর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রক খালেদ, ওয়াহাব, রাজু, রিয়াজ এবং শাহাব উদ্দিন। আর শ্যামলী কাউন্টারের সামনে থেকে যেসব গাড়ি ছেড়ে যায় সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন মিতালি পরিবহণের কয়েকজন চালক।
অপরদিকে যাত্রীরা অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে জিম্মি করে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। আর মাইক্রোবাসের শ্রমিকরা বলছেন, সিলেট থেকে ঢাকা স্বাভাবিক সময়ে রিজার্ভ গেলেও ১০ হাজার টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু লকডাউনের সময়ে ঝুঁকি নিয়ে গেলেও চাঁদাবাজির কারণে বাড়তি কোনো টাকা পাওয়া যাচ্ছে না।
লকডাউনে শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করলেও মুষ্টিমেয় কয়েকজন শ্রমিকদের নিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় ক্ষোভ বিরাজ করছে সাধারণ শ্রমিকদের মাঝে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শ্রমিক বলেন, ‘গাড়ি বন্ধ থাকায় আমরা সাধারণ শ্রমিকরা অসহায়। আর শ্রমিক নেতারা আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন। কথায় আছে, কারও পৌষ মাস আর কারও সর্বনাশ।’
তবে এমন কোনো তথ্য জানেন না বলে জানালেন সিলেট জেলা সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মুহিত। তিনি বলেন, ‘কেউ চাঁদা আদায় করে বলে আমার জানা নেই। আমি খোঁজ-খবর নিয়ে দেখেছি, দিনে সম্ভবত ৪ থেকে ৫টি গাড়ি ছাড়ে। এগুলো বন্ধ করতে বলে দিয়েছি। তবে কোনোরকম চাঁদা আদায় করা হয় না। আর হলেও আমি বা আমার সভাপতি তা জানেন না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ’র সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘লকডাউনে এমন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমি দেখছি বিষয়টি।’
সূত্র: সিলেট ভয়েস