Advertisement (Custom)

বিজ্ঞাপন
প্রকাশিত: রবিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২১
সর্বশেষ সংষ্করণ 2021-04-24T19:26:13Z
লিড নিউজসারাদেশ

করোনা ইউনিটে কাজ করতে গিয়ে সালমার গর্ভেই নষ্ট হয়েছে দুই সন্তান

বিজ্ঞাপন

ডেস্ক রিপোর্ট : করোনা হাসপাতালের আইসিইউতে দায়িত্ব পালন করে দুবার পজেটিভ হয়েছি। এই দুবারে আমার দুটো ভ্রূণ নষ্ট হয়েছে। করোনা পজেটিভ হয়েও ছুটি পাইনি। অসুস্থ শরীর নিয়ে ডিউটি করেছি। শরীরে রক্তশূন্যতা, তাই ধারদেনা করে ওষুধ কিনে খাই। অথচ এগারো মাস ধরে বেতন পাই না। খেয়ে না খেয়ে আছি। টাকার অভাবে নিজের বাসা ছেড়ে উঠেছি বাবার বাসায়।

অফিস থেকে বারবার বলছে বেতনও পাবো না আর চাকরিও থাকবে না। একটা মাত্র ছেলের কলেজের বেতন-ভাতা সময়মতো দেইনি বলে অভিমানে আত্মহত্যা করে সেও দুনিয়া থেকে চলে গেছে। স্বামীও আমাকে ছেড়ে আরেকটি বিয়ে করেছেন। এখন কি করবো? কোথায় যাবো জানি না। অঝোর ধারায় কেঁদে কেঁদে কথাগুলো বলছিলেন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মী সোনিয়া আক্তার সালমা (৩৩)। তিনি আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে দীর্ঘ ৯ বছর ধরে হাসপাতালটিতে কাজ করছেন। বিগত বছরগুলোয় ঠিকমতো বেতন-ভাতা পেলেও ১১ মাস ধরে কোনো বেতন পাচ্ছেন না। বিনা বেতনেই এই সময়টা নিয়মিত ডিউটি করে যাচ্ছেন। 

শুধু সোনিয়া আক্তার সালমা নন তার মতো ঢাকার মুগদা জেনারেল হাসপাতালের আউটসোসিং পদ্ধতিতে নিয়োগ পাওয়া ১৩৯ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ১১ মাস বেতন না পেয়ে মানববেতর জীবন যাপন করছেন। করোনা ডেডিকেটেড মুগদা হাসপাতালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা দিনের পর দিন কাজ করে যাচ্ছেন। অথচ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদেরকে চাকরি থেকে অব্যাহতিও দিচ্ছেন না আবার বেতনও দিচ্ছেন না। তারা জানেন না আদৌ তাদের ভাগ্যে কি আছে। দীর্ঘ বেতন-ভাতা না পেয়ে এসব কর্মী খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন। করোনাকালে চিকিৎসক-নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন-ভাতার পাশপাশি প্রণোদনার ব্যবস্থা থাকলেও তারা ন্যায্য বেতনটা পাচ্ছেন না। 

গতকাল মুগদা হাসপাতালে বসে সালমা বলেন, এক আত্মীয়ের মাধ্যমে হাসপাতাল উদ্বোধনের সময় এখানে আমি চাকরি পেয়েছি। শুরুতে আমাকে বলা হয়েছিল এটি সরকারি চাকরি। পরে জানতে পারি এটা অস্থায়ী চাকরি। প্রথম দিকে আমি অন্যান্য পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করতাম। প্রতিদিন তাদের হাজিরা ও স্বাক্ষর নেয়া ছিল আমার কাজ। কয়েক বছর এই কাজ করার পর আমাকে সরিয়ে দেয়া হয়। তারপর বিভিন্ন ওয়ার্ডে কাজ করেছি। করোনাকালীন সময়ে হাসপাতালটিকে করোনা ডেডিকেটেড করার পর আইসিইউতে আমার ডিউটি পড়ে। গরমের মধ্যে পিপিই পরে সতর্কতার মধ্যে ডিউটি করতে হতো। কিন্তু পিপিই পরে ডিউটি করতে অনেক কষ্ট হতো। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে যেতাম। ওইসময় আমার পেটে ভ্রূণ ছিল। তখন আমি করোনা পজিটিভ হয়ে যাই। তখন আমার ভ্রূণটি নষ্ট হয়ে যায়।

 একইভাবে গত মাসেও করোনা পজিটিভ হয়ে আমার তিন মাস বয়সী আরেকটি ভ্রূণ নষ্ট হয়েছে। তিনি বলেন, বাল্য বয়সে বিয়ে হয়েছে। আমার একটি ছেলে সন্তান ছিল। এসএসসি পাস করার পর ভালো দু’টি কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু ভর্তি করাতে পারিনি। ভেবেছিলাম আর পড়াশোনা করাতে পারবো না। কিন্তু তার বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতায় সাইক ইন্সস্টিটিউট অব মেডিকেল টেকনোলজিতে ভর্তি করাই। দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করা কালীন সময়ে টাকার অভাবে তিন মাসের বেতন দিতে পারি নাই বলে ২০১৭ সালের ১৭ই জানুয়ারি আমার সঙ্গে অভিমান করে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে সে আত্মহত্যা করেছে। এখন আমি একা। স্বামী-সন্তান কেউ নাই। একদিকে বেতন পাই না। অন্যদিকে চাকরি হারানোর ভয়। দু’টো ভ্রূণ ও একমাত্র ছেলেটাকে হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। 

আরেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী মাসুদ বলেন, ১১ মাস ধরে বেতন পাই না। ১৩৯ থেকে ১০ জন বাদ দিয়ে রি-টেন্ডার করতে বলছিল। তা না করে ভুল করে আমাদেরকে রেখেই আবার ১২৯ জন নিয়োগ দিয়েছে। ভাবছে এগুলো নতুন নিয়োগ। এখন এই ১৩৯ জনই মানববেতর জীবনযাপন করছে। এখন নাকি মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বাক্ষর করলেই হয়ে যাবে। এখন কতোটা সত্য সেটা জানি না। ওই আশায়ই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সামনে নতুন বাজেট কী হবে জানি না। করোনাকালে কতটা ঝুঁকি নিয়ে আমরা কাজ করছি। রোগীর মলমূত্রসহ যাবতীয় সবকিছুই আমরা পরিষ্কার করি। চিকিৎসক-নার্সরা প্রণোদনা পাচ্ছেন আমরা পাচ্ছি না। অপরিষ্কার সব কাজই আমরা করছি। 

মুগদা হাসপাতাল প্রশাসন সূত্র বলছে, প্রশাসনিক কোনো অনুমোদন ছাড়া ১৩৯ জনের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। মন্ত্রণালয় থেকে আসা বরাদ্দ থেকে তৎকালীন পরিচালক এই কর্মীদের বেতন দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু সরকারি অডিটে এই বেতন প্রক্রিয়া বন্ধ করার জন্য ওই পরিচালকের বিরুদ্ধে অডিট আপত্তি দিয়েছে। তারপর থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে ওই কর্মীদের বেতন ভাতা। কয়েক বছর আগে এই কর্মীদের থেকে দশজন বাদ দিয়ে রি-টেন্ডার করে তাদের পুনঃনিয়োগ দেয়ার কথা থাকলে ফের নতুন জনবল নিয়োগ দিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এই নিয়োগে প্রশাসনিক অনুমোদন থাকায় তারা বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। প্রশাসন সূত্র বলছে, পুরাতন ১৩৯ জনের নিয়োগে প্রশাসনিক অনুমোদন ও তাদের বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। অনুমোদন এলেই তাদের বেতন-ভাতা শুরু হবে। 

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জনবল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান চিত্রা এন্টারপ্রাইজের মালিক গোলাম কিবরিয়া রাজা মানবজমিনকে বলেন, গত বছরের জুন মাসে হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক মন্ত্রণালয় বরাবর বরাদ্দ চেয়ে একটি চিঠি দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু তখন ওই চিঠি দেয়া হয়নি। দুই মাস পরে ওই কর্মীদের বেতন দিতে গিয়ে দেখা যায় বরাদ্দ নাই। আমরা তখনকার পরিচালককে বলে তদবির শুরু করি। করোনার কারণে ওই সময় সেই প্রক্রিয়া আর বেশিদূর যায়নি। এখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বরাদ্দ চেয়ে একটি চিঠি মন্ত্রণালয়ে দিয়েছে। সাবের হোসেন চৌধুরী এমপিও ভার্চ্যুয়াল সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে এ বিষয়ে অবহিত করেছেন। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরাও বেশি কথা বলতে পারছি না। বেশি বললে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলবে যেহেতু বরাদ্দ বা নিয়োগপত্র নাই তাহলে আমরা কীভাবে বেতন চাই। আবার মন্ত্রণালয় বলে দুই বছর ধরে বরাদ্দ নেয়া হয়নি। এখন মোটামুটি একটা পর্যায়ে আছে আশা করি খুব শিগগির হয়ে যাবে। 

মুগদা হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি আর কে চৌধুরী রিজন মানবজমিনকে বলেন, প্রশাসনিক জটিলতার কারণে এই সমস্যা হয়েছে। অথচ অফিস তাদেরকে বাদ দেয়নি উল্টো কাজ করাচ্ছে। এখন তারা কেউ দায়ভার নিচ্ছে না। এসব বিষয় নিয়ে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। এমপি মহোদয় এটি নিয়ে কাজ করছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বরাবর চিঠিও লিখেছেন। তিনি বলেন, ১৩৯ জন কর্মচারী করোনাকালীন সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু তারা কোনো বেতন-ভাতা বা প্রণোদনা পাচ্ছেন না। বিষয়গুলো নিয়ে হাসপাতাল প্রশাসনকে কেউ কোনোদিন প্রশ্নের সন্মুখীন করে নাই। তাই তারা বেঁচে যাচ্ছে। যদি এই সমস্যাটা চিকিৎসক বা নার্সদের বেলায় হতো তাহলে সবার চোখে পড়তো। কিন্তু এরা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হওয়াতে কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না। তিনি বলেন, ১৩৯ জন হাসপাতালের শুরু থেকেই দায়িত্ব পালন করছেন। কয়েকবছর আগে ১২৯ জনের আরেকটি টেন্ডার আহ্বান করা হয়। কথা ছিল ওই ১৩৯ জন থেকে ১০ জন বাদ দিয়ে ১২৯ জনকে পূর্ণ নিয়োগ দেয়ার। কিন্তু সেটি না করে নতুন করে আবার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া এই কয়েক বছরে মুগদা হাসপাতালে অনেক পরিচালক পরিবর্তন হয়েছেন। শুধু গত এক বছরেই তিনজন পরিচালক বদলি হয়েছেন। নতুন পরিচালক এসে আগের পরিচালকের ফাইল ধরতেই চান না। এসব করার জন্য এই কর্মচারীদের ভাগ্য পিছিয়ে গেছে। হাসপাতাল প্রশাসন দায় না নেয়ার কারণে তাদের ক্ষতি হয়ে গেছে। আমি নিজে প্রশাসনকে বলেছি বেতন না নিলে কর্মচারীরা আন্দোলনে যাবে, কর্ম বিরতিতে যাবে। এসব বলার কারণে তাদের টনক নড়েছে। তবে বাস্তবে কী হচ্ছে সেটা এখনও আমরা জানি না। 

মুগদা হাসপাতালের বর্তমান পরিচালক ডা. অসীম কুমার নাথ  বলেন, যারা বেতন পাচ্ছে না তাদের নিয়োগটা তখন প্রশাসনিক অনুমোদন ছাড়াই নিয়োগ হয়েছে। এখন আমরা মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখেছি। সেই চিঠিতে প্রশাসনিক অনুমোদন দেয়ার কথা বলেছি। যদি প্রশাসনিক অনুমোদন পেয়ে যাই তাহলে তারা বেতন পাবে। এবং তারা করোনাকালে কাজ করেছে তাই তাদের বেতন যেন দেয়া হয় সেটিও চিঠিতে বলা হয়েছে। প্রশাসনিক অনুমোদন ছাড়া এতো বছর তারা কীভাবে বেতন পেলো? এমন প্রশ্নের জবাবে পরিচালক বলেন, আগের যে পরিচালক তাদেরকে বেতন দিয়েছেন তার বিরুদ্ধে অডিট অবজেকশন দিয়েছে। নতুন যারা নিয়োগ পেয়েছে তারা বেতন পাচ্ছে কিন্তু পুরাতনরা পাচ্ছে না কেন? জবাবে তিনি বলেন, নতুনদের নিয়োগে প্রশাসনিক অনুমোদন আছে তাই তারা পাচ্ছে। আর পুরাতনদের অনুমোদন নাই। আগের বছরগুলোতে যে ফান্ড এসেছে ওই ফান্ড থেকেই তারা বেতন পেয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

জনপ্রিয় সংবাদ