বিজ্ঞাপন
ডেস্ক রিপোর্ট : ‘ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়’ এই চিরন্তন বাক্যটি আজ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল প্রবাসী অধ্যুষিত নবীগঞ্জ উপজেলার নিভৃত্য পল্লীতে। এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন এক মহীয়সী নারী। স্বামীর অঢেল সম্পদ থাকলেও শুধু নিয়ত (মানত) করার কারণে একক প্রচেষ্টায় তিল তিল করে গড়ে তোলেন এই মসজিদ।
আজ থেকে ১১৯ বছর আগে জনৈক বেঙ্গির মার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নির্মিত হয়েছিল মসজিদটি। ‘ছোট ছোট বালু কণা, বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মাহাদেশ, সাগর অতল’ কবিতাটির মতো করে দাঁড় করিয়েছেন মসজিদটি। ফলে তার নামে মসজিদটির নামকরণ অর্থাৎ বেঙ্গির মায়ের মসজিদ।
শতবর্ষ পরেও আজ মসজিদের অভ্যন্তরে নিয়ন বাতিতে জ্বল জ্বল করে জ্বলছে ‘প্রজাতপুর ও লালাপুর জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠাতা বেঙ্গির মা’। শুধু নিয়ন বাতি কেন এলাকাবাসীর অন্তরে যা আজো তার নাম উজ্জ্বলতর তারকা হয়ে আছেন তিনি।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছেন তিনি। তাকে সবাই ‘বেঙ্গির মা’ বলে ডাকলেও একটি মহৎ উদ্যোগ নিয়ে একটি আন্ডা বা ডিম থেকে গড়ে তুলেছেন একটি মসজিদ। এলাকাবাসী নাম দিয়েছেন ‘এক আন্ডার মসজিদ’। মসজিদটির নাম এখন সবার মুখে মুখে।
এক আন্ডা থেকে কীভাবে এক মসজিদ, সে কথা শুনলে সবাই অবাক হন। মানুষের অসাধ্য কিছু নেই, মানুষ সাধনা করে আকাশে উড়েছে, পৌঁছেছে চাঁদের দেশে। তেমনি এক বেঙ্গির মা বাংলাদেশে জন্ম দিয়েছেন এক ইতিহাস। আর তার রেখে যাওয়া স্মৃতি দেখার জন্য প্রতিদিন শত শত মানুষ আসে বেঙ্গির মায়ের এক আন্ডা মসজিদ দেখতে।
জানা গেছে, হবিগঞ্জ জেলার প্রবাসী অধ্যুষিত নবীগঞ্জ উপজেলার ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের প্রজাতপুর গ্রামের তৎকালীন এক কৃষক সরফ উল্লার স্ত্রী বেঙ্গির মা ১৯০২ ইরেজি ও ১৩০৭ বাংলা সনে প্রজাতপুর ও লালাপুর দুটি গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।
মসজিদ নির্মাণ শেষে এলাকাবাসীকে একত্র করে নামকরণ করেন ‘এক আন্ডার মসজিদ’। তখন মসজিদের নামকরণ নিয়ে জনতার মধ্যে প্রশ্ন জাগলে তিনি ঘটনাটি খুলে বলেন। বেঙ্গির মা এলাকাবাসীকে জানান, তিনি একটি মুরগির ডিম মসজিদের নামে মানত করে রাখেন। ওই ডিম মুরগির উতলে দিলে তা থেকে একটি বাচ্চার জন্ম হয়।
পরে ওই বাচ্চা বড় হলে তা থেকে আরও ৭টি ডিম হয়। এরপর ওই ৭ ডিম থেকে ৭টি বাচ্চার জন্ম হয়। এভাবে একপর্যায়ে মুরগির খামার গড়ে তোলেন তিনি। ওই খামারের মুরগি বিক্রি করে বেঙ্গির মা টাকা জমাতে থাকেন। সে সময়ে তিনি এক লাখ টাকা জমা করে মসজিদটি তার স্বামীর মাধ্যমে নির্মাণ করে দেন।
বেঙ্গির মা ছিলেন নিঃসন্তান। ঘটনা এলাকায় জানাজানি হওয়ার পর মসজিদটির নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। মসজিদ নির্মাণের শত বছর অতিবাহিত হলেও এখন এ কাহিনী সবার মুখে মুখে। অনেকেই মনে করেন, একটি ডিম থেকে একটি মসজিদ নির্মাণের ঘটনা ইতিহাসে এই প্রথম। তাও আবার একজন মহিলা কর্তৃক মসজিদ নির্মাণ সবাইকে অবাক করেছে।
প্রজাতপুর ও লালপুর গ্রামবাসী ২০০৯ সালে মসজিদটির বর্ধিত অংশ সংস্কার করেছেন। কিন্তু বেঙ্গির মার মূল মসজিদটি এখনো বিদ্যমান রয়েছে। চলতি বছরে মসজিদটি নতুন করে রং করা হয়েছে।
এক আন্ডার মসজিদের খতিব মাওলানা আলমাছ উদ্দিন বলেন, ‘আমি মসজিদ নির্মাণে বেঙ্গির মার এক আন্ডার গল্প শুনে অবাক হয়েছি। ইচ্ছা থাকলে মানুষ কী না করতে পারে। তার ছেলে সন্তান না থাকলেও এই মসজিদটি পৃথিবী যত দিন থাকবে তত দিন সাক্ষী হয়ে রবে।’
বেঙ্গির মার এক নিকটাত্মীয় প্রজাতপুর গ্রামের রাকিল হোসেন বলেন, ‘আমার পূর্বপুরুষ নিঃসন্তান সরফ উল্লার স্ত্রী বেঙ্গির মা এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। আমি আমার বাবার কাছ থেকে শুনেছি পরিদাদি বেঙ্গির মা একটি আন্ডা থেকেই এই মসজিদ নির্মাণ করেন।’
বর্তমানে এলাকাবাসী কয়েক লাখ টাকা ব্যয় করে মসজিদের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য সংস্কার করেছেন। মসজিদের মোতাওয়াল্লি লন্ডন প্রবাসী আবদুল হারিছ। কিন্তু তিনি দেশের বাইরে থাকায় তাকে পাওয়া যায়নি।
প্রজাতপুর গ্রামের প্রবীণ মসজিদের নিয়মিত মুসল্লী উলফর উল্লাহ বলেন, ‘আমাদের গ্রামের বেঙ্গির মা এমন একটি কাজ করেছেন, যা সারা জীবনেও ভোলার মতো নয়। আমি বেঙ্গির মার কাছ থেকে শুনেছিলাম তিনি একটি ডিম থেকে একটি মুরগির খামার গড়ে তুলেছিলেন। ওই খামারের একটি টাকাও তার সংসারের কাজে ব্যয় করেননি। সম্পূর্ণ টাকা দিয়ে মসজিদ নির্মাণ করেন। মানুষটি (বেঙ্গির মা) মারা গেলেও এখনো সবাই তার কথা আলোচনা করে। এটা বিশ্বে নজির হয়ে থাকবে।’
মসজিদ পরিচালনা কমিটিতে রয়েছেন বেঙ্গির মার বংশধর রূপ উদ্দিন সভাপতি, লন্ডন প্রবাসী আবদুল হারিছ মোতাওয়াল্লি, ব্যবসায়ী হেলিম উদ্দিন ক্যাশিয়ার, সদস্য রাকিল হোসেন ও শামীনুর মিয়া। কমিটির একাধিক সদস্যের মতে, বেঙ্গির মার এক আন্ডার মসজিদটি পর্যটকদের জন্য একটি আশ্চর্যজনক স্থাপত্য হিসেবে সরকার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেবে।