বিজ্ঞাপন
জি ভয়েস ডেস্ক : নগরীর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হান আহমদকে হত্যাকান্ডের পর বরখাস্ত হওয়া এস আই আকবরকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছিলেন ফাঁড়ির তৎকালীন টুআইসি এস আই হাসান আলী। কোম্পানীগঞ্জের সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল নোমান ও এস আই হাসান মিলে ফাঁড়ির সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজ গায়েব করে দেয়। হাসানের নেতৃত্বেই ঘটনার অন্যতম আলামত হার্ডডিস্ক পাল্টে ফেলে তারা। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানিয়েছে। গত শনিবার হাসানকে রিমান্ডে নেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
আলাপকালে পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার মো. খালেদ উজ্জামান এসব তথ্য নিশ্চিত করে জানান, সাংবাদিক নোমানকে এখন দরকার। তার কাছ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে বলে জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা।
পিবিআই সূত্রে জানা গেছে, গত শুক্রবার রাতে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া এসআই হাসানকে নগরীর মিরের ময়দানের নগর পুলিশ লাইন্স থেকে গ্রেফতার করে পিবিআই।
পরদিন শনিবার সিলেটের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো.আব্দুল মোমিনের আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে ৩ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়। শুনানী শেষে আদালত একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ঐ দিন হাসানকে পিবিআই তাদের হেফাজতে নিয়ে যায়। তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পরদিন রোববার তাকে আদালতে হাজির করা হলে আদালত জেল হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন।
সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে হাসান চাঞ্চল্যকর বেশকিছু তথ্য দিয়েছে। ঘটনার পর দ্রুত নগরীর জল্লারপারের গ্যালারিয়া শপিং সিটির একটি দোকান থেকে ১ হাজার ২০০ টাকার ৫০০ গিগাবাইটের হার্ডডিস্ক কিনে এনে বন্দরবাজার ফাঁড়ির পুরনো হার্ডডিস্কটি বদলে দেয় হাসান ও নোমান। ঘটনার পর সাময়িক বরখাস্ত আকবর তার অস্ত্র টুআইসি হিসেবে হাসানের নিকট জমা দেয়। এরপর আকবরকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেন হাসান। ঘটনার আগে ও পরে ২৪ ঘণ্টায় হাসান ও নোমানের মাঝে অন্ততঃ ৫৯ বার মোবাইল ফোনে কথা হয়েছে। হাসান ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট আকবর পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টিও প্রথমে গোপন করেন। রিমান্ডে এ সকল তথ্য দেয়ার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ আরো কিছু তথ্য দিলেও আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে রাজি হয়নি হাসান।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা(আইও) ও পিবিআই সিলেটের পরিদর্শক আওলাদ হোসেন জানান, হাসানকে গ্রেফতারের পর একদিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে তাকে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়। তবে জিজ্ঞাসাবাদে কি তথ্য পাওয়া গেছে তা বলতে রাজি হননি আইও।
জানা গেছে, রায়হান হত্যার পর ২১ অক্টোবর এসআই হাসানকে সাময়িক বরখাস্ত করে মহানগর পুলিশ। এরপর থেকে তাকে নগর পুলিশ লাইন্সে বিশেষ নজরদারীতে রাখা হয়েছিল। রায়হান হত্যার পর হাসান, আকবরসহ এ পর্যন্ত ৫ পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হাসানকে গ্রেফতারের পর মামলাটি নতুন মোড় নিয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার মো. খালেদ উজ্জামান বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্য দিয়েছে হাসান। তদন্তেও এ বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্তে পাওয়া সকল তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এজন্যে অভিযোগপত্র দিতে কিছুটা বিলম্ব হবে।
পিবিআই সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য দারোগা আকবরের মোবাইল ফোন ও সিম- পিবিআইর নিজস্ব ল্যাবে পাঠানো হয়। গ্রেফতারের কয়েক দিন পর কানাইঘাটের সীমান্ত এলাকা থেকে আকবরের ২টি মোবাইল ফোন সেট, ৩টি সিম কার্ড, শার্ট, প্যান্ট, গেঞ্জি ও পাসপোর্ট সাইজের দু’টি ছবি ও এক নারীর দু’টি ছবি উদ্ধার করে পুলিশ।
প্রাথমিকভাবে এগুলো আকবরের বলে নিশ্চিত হওয়া গেলেও নারীর ব্যাপারে তেমন তথ্য মেলেনি। মূল অভিযুক্ত আকবরসহ ৪ পুলিশ সদস্যকে রিমান্ডে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। হত্যাকাণ্ডের দু’দিন পর ১৩ অক্টোবর মামলাটি কোতোয়ালী থানা থেকে পিবিআই’র কাছে স্থানান্তর করে পুলিশ সদর দপ্তর। এর আগের দিন নিহত রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি বাদী হয়ে কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-২০। ধারা ৩০২/৩৪ দণ্ডবিধি তৎসহ নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ১৫(১)(২)(৩)২০১৩।
সূত্র জানায়, সীমান্ত এলাকায় গ্রেফতারের আগে আকবরের স্বীকারোক্তির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। কয়েকটি খণ্ড ভিডিও’র একটিতে আকবর জানান, ‘সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন আপাতত চলে যাও, ২ মাস পরে চলে আসবা, ২ মাস পর মোটামুটি সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে ২ মাস পরে চলে আসবে।’ ৯ নভেম্বর সকালেই তার এই বক্তব্য ভাইরাল হয়।
কিন্তু এখনো সিনিয়র কর্মকর্তাকে শনাক্ত করা হয়নি। যার পরামর্শে ১৩ অক্টোবর কোম্পানীগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যায় আকবর। পিবিআই এ বিষয়ে কোন তথ্য দিতেও রাজি হয়নি। আকবর নিজেও তদন্তকারীদের কাছে স্বীকার করেন, ‘কোম্পানীগঞ্জের মাঝেরগাঁও এর একটি পরিবার পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।’
সূত্র জানায়, কোম্পানীগঞ্জের সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল নোমান, সিলেট জেলা পরিষদ সদস্য তামান্না আক্তার হেনা ও তার স্বামী হেলাল আহমদ আকবরকে সীমান্ত পার হতে সহযোগিতা করেন। এমনকি হেনা দম্পতির ঘরে এক রাত ছিলেন আকবর এমন তথ্যও পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
রায়হান হত্যার পর সাময়িক বরখাস্তের পরই কৌশলে সাংবাদিক নোমানের সহযোগিতায় নগর ছেড়ে কোম্পানীগঞ্জে পালিয়ে গিয়ে আত্মগোপন করে আকবর। এরপরই ভারতে পালিয়ে যায়। ৯ নভেম্বর সকালে কানাইঘাটের ডনা সীমান্ত থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। বিভিন্ন মাধ্যমে কৌশলে পুলিশ তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
আদালত সূত্র জানায়, রায়হান হত্যাকাণ্ডের ১০ দিন পর ২০ অক্টোবর সর্বপ্রথম কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাশকে গ্রেফতার দেখানো হয়। এরপর ২৪ অক্টোবর কনস্টেবল হারুন, ২৯ অক্টোবর এ এস আই আশেক এলাহীকে গ্রেফতার দেখায় পিবিআই। সাময়িক বরখাস্তের পর পুলিশ প্রহরায় ছিলেন তারা।
কনস্টেবল টিটু ও হারুনকে দুই দফায় ৮ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। এএসআই আশেক এলাহীকে ৫ দিনের রিমাণ্ডে নেয়া হয়। ৯ নভেম্বর গ্রেফতারের পর দারোগা আকবরকে টানা ৭ দিনের রিমাণ্ডে নেয় পিবিআই। গত শুক্রবার সর্বশেষ গ্রেফতার করা হয় এসআই হাসান আলীকে। তাকেও ১ দিনের রিমান্ডে নিয়েছিলো পিবিআই। ৫ পুলিশ সদস্যকে রিমাণ্ডে জিজ্ঞাসাবাদের পরও কোন আসামী আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়নি।
পুলিশ সূত্র জানায়, রায়হান হত্যার পর ১২ অক্টোবর এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া, এএসআই তৌহিদ মিয়া, কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাশ ও হারুনুর রশিদকে সাময়িক বরখাস্ত করে এসএমপি। একই দিন বন্দরবাজার ফাঁড়ি থেকে এএসআই আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজীব হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়। আকবরকে পালাতে সহায়তাকারী হিসেবে এসআই হাসান আলীকে ২১ অক্টোবর সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কোতোয়ালী থানার পরিদর্শক সৌমেন মিত্র ও এসআই আব্দুল বাতেনকে ১৮ নভেম্বর সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের ৪ দিন পর তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৫ অক্টোবর এসএমপি কমিশনার গোলাম কিবরিয়া রায়হানের বাড়িতে যান। ২২ অক্টোবর কমিশনার গোলাম কিবরিয়াকে এসএমপি থেকে বদলী করে পুলিশ সদর দপ্তর। দারোগা আকবর, এএসআই আশেক এলাহী, কনস্টেবল টিটু ও হারুন সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছে।
প্রসঙ্গত, নগরীর আখালিয়ার নেহারীপাড়ার বাসিন্দা রায়হান আহমদকে ১১ অক্টোবর দিবাগত রাতে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে আসে। রাত ৩টা ৯ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে স্বাভাবিক অবস্থায় রায়হানকে ফাঁড়িতে ধরে আনে পুলিশ। সকাল ৬টা ২৪ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে রায়হানকে ফাঁড়ি থেকে বের করা হয়। ৬টা ৪০ মিনিটে ওসমানী হাসপাতালে নেয়া হয় এবং ৭টা ৫০ মিনিটে মারা যায় রায়হান। ঐ দিনই ময়না তদন্ত শেষে তার লাশ দাফন করা হয়। পরে ১৫ অক্টোবর কবর থেকে রায়হানের লাশ উত্তোলন করে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে পুনরায় ময়নাতদন্ত করা হয়।
নির্যাতনে রায়হানের হাতের দু’টি আঙ্গুলের নখ তুলে ফেলে দারোগা আকবর। রাতভর নির্যাতনে রায়হানের শরীরে ময়নাতদন্তে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৪টি আঘাত ছিল গুরুতর। নির্যাতনের সময় রায়হানের আর্তচিৎকারে ফাঁড়ির পার্শ্ববর্তী কুদরত উল্লা রেস্ট হাউসের বর্ডারদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের পর ঘাতকদের গ্রেফতারের দাবিতে দলমত নির্বিশেষে সিলেটবাসী আন্দোলনে নামেন। সড়ক অবরোধ, মানববন্ধন, মিছিল-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। বৃহত্তর আখালিয়াবাসী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেন।