বিজ্ঞাপন
ফাহিম আহমদ: ষাটোর্ধ আমিন আলী। উত্তর আলমপুর গ্রামের বাসিন্দা। প্রায় ২বছর আগে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাড়াতাড়ি হাসপাতালে না পৌঁছানোর আগেই গ্রামের রাস্তায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তেরাব আলী ২০১৭ সালে যখন আমেরিকা থেকে দেশে আসেন। তখন তিনি স্ট্রোক করেন। সে সময় উনাকে রাস্তার দুর্ভোগের কারণে ৩ কিলোমিটার রাস্তা বাঁশের মাচাং তৈরি করে ভাদেশ্বর হয়ে সিলেটের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
শুধু আমিন আলী আর তেরাব আলী নয়। এরকম আরো অনেক উদাহরণ আছে। গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাদেপাশা ইউনিয়নের প্রায় ২০-২৫ হাজার মানুষের যাতায়াতের একমাত্র অবলম্বন উত্তর আলমপুরের আলমপুর-মাসুরা (খুর্শিদের খেয়াঘাট) রাস্তা। খালের গর্ভে বিলীন হচ্ছে ১৫ টি গ্রামের মানুষের চলাচলের এই রাস্তাটি। এক সময় এ সড়ক দিয়ে সিএনজি অটোরিকশা চলাচল করতো। এখন একজন মানুষও এই রাস্তা দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয়।
জানা যায়, প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় থেকে রাস্তাটি ভাঙনের কবলে পড়েছে। যতই দিন যাচ্ছে রাস্তা ভেঙে বড় হচ্ছে খাল, সরু হচ্ছে রাস্তা। সেই সাথে এখানকায় বসবাসরত বাসিন্দাদের দুর্ভোগ যেন আকাশ ছোঁয়া। বাদেপাশা ইউনিয়নে রয়েছে কুশিয়ারা পুলিশ ফাঁড়ি। ১৫টির বেশি গ্রামের মানুষের সাথে কষ্ট পোহাতে হচ্ছে এখানে দায়িত্ব রত পুলিশ সদস্যদের। বাদেপাশা ও ভাদেশ্বর এ দুই ইউনিয়নের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে উত্তর আলমপুরের আলমপুর-মাসুরা (খুর্শিদের খেয়াঘাট) রাস্তা। রাস্তাটি আধা কিলোমিটার বাদেপাশা ইউনিয়নের অধীনে থাকলেও আড়াই কিলোমিটার ভাদেশ্বর ইউনিয়নের অধীনে রয়েছে। এ সড়ক দিয়ে ছিলিমপুর, খাটাকালির পাড়, কোনাগাঁও, উত্তর আলমপুর, কুলিয়া, কেউটকোনা, রাকুয়ারবাজার, দক্ষিণ আলমপুর, বাগলা, সুপারটেক, সোনার পাড়া ও কালাইন সহ বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ যাতায়াত করেন।
রাস্তাটি দেখলে মনে হয় না যে এটি সড়ক ছিল। অনেক জায়গায় রাস্তা ভেঙে খালে চলে যাওয়ায় কৃষি জমি দিয়ে মানুষকে যাতায়াত করতে হচ্ছে। সব চেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয় গর্ভবতী নারী ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীদের। এ ইউনিয়নের ১৫ টির বেশি গ্রামে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়। রয়েছে মসজিদ।
এলাকাবাসী জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও ভাল মানের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত এই ইউনিয়নের শিক্ষার্থীরা। যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের জন্য ভাল মানের শিক্ষক-মসজিদের জন্য ইমাম পাওয়া যায় না। উত্তর আলমপুর জামে মসজিদ যেতে হলে ব্রিজ পাড় হয়ে যেতে হয়। কিন্তু দীর্ঘ দিন যাবত খালের ভাঙনে ব্রিজের পাশ ভেঙে গিয়ে যাতায়াতের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। স্থানীয়রা বাঁশের মাচাং তৈরি করে ব্রিজের সাথে সংযোগ করে ঝুঁকি নিয়ে মসজিদে যাতায়াত করেন। এই ইউনিয়নের যে সকল শিক্ষার্থীরা কলেজ-ভার্সিটিতে লেখাপড়া করে তারা পরীক্ষার আগে তাদের আত্মীয়ের বাসা বা হোস্টেল ভাড়া করে সেখানে থেকে পরীক্ষা দেন। এই ইউনিয়নের অনেক মানুষ কৃষি কাজ করেন। বছরে তাদের ভাল ফলন হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না হওয়া তারা ফসল বিক্রি করা থেকে বঞ্চিত। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না হওয়ায় কুশিয়ারা পাড়ে বসবাস হওয়া স্বত্বেও তাদের রয়েছে মাছের চাহিদা। সরেজমিন রাস্তার খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায়, মাত্র ৩ কিলোমিটার রাস্তার কারণে কতটা অসহায়ত্ব বিরাজ করছে সেখানকার মানুষের মধ্যে। তারা অনেকটা অবহেলিত ভাবে পড়ে আছেন।
স্থানীয় বেশ কয়েকজনের সাথে কথা হলে তারা বলেন, কোন ভাবেই রাস্তাটি সংস্কার করানো যাচ্ছে না। এমন কোন জায়গায় নেই যেখানে আমরা রাস্তাটির জন্য আবেদন জানাইনি। যার কাছে যাই, যেখানে যাই তারা শুধু আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন। দুই যুগ পার হলেও আশ্বাস যেন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে না।
এদিকে আলমপুরের উত্তর আলমপুর-মাসুরা (খুর্শিদের খেয়াঘাট) রাস্তা সংস্কারের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেন এলাকাবাসী। এরপর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রহমান ও উপজেলা প্রকৌশলী মাহমুদুল হাসান এ রাস্তাটি পরিদর্শন করেন। মঈন উদ্দিন পাখি নামের স্থানীয় এক বৃদ্ধ অনেকটা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে প্রতিবেদককে বলেন, বৃদ্ধ হয়েছি। হয়তো এখন শরীর ভাল। কোন সময় খারাপ করবে বলা যায় না। যদি বেশি খারাপ হয় তাইলে হাসপাতাল তো দূরের কথা এই ভাঙা রাস্তায় মৃত্যু বরণ করতে হবে।
মো. জাকির হোসাইন বলেন, এক সময় আলমপুরের এই রাস্তা দিয়ে যানবাহনও চলাচল করতো। এখন যানবাহন চলাচল দূরের কথা মানুষ চলাচল কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করেও কোন লাভ হচ্ছে না।
১নং বাগলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লুৎফুর রহমান বলেন, আমাদের দুর্গতির কোন শেষ নেই। দিন দিন তা চরম আকার ধারণ করছে। কখন, কি ভাবে এই রাস্তাটি মেরামত করে হাজার-হাজার মানুষের দুর্ভোগ লাগব করা হবে তা জানা নেই।
এ ব্যাপারে উপজেলা প্রকৌশলী মাহমুদুল হাসান বলেন, রাস্তাটি পরিদর্শন করেছি। এখন সার্ভে করে মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাবনা পাঠাবো এবং স্থানীয় এমপি মহোদয়কেও এ বিষয়ে অবহিত করা হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রহমান জানান, রাস্তাটি আসলেই অস্তিত্ব সংকটে সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে বুঝতে পেরেছি। শিগগিরই মেরামতের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হবে।