Advertisement (Custom)

বিজ্ঞাপন
প্রকাশিত: মঙ্গলবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২১
সর্বশেষ সংষ্করণ 2021-02-09T04:19:08Z
গোলাপগঞ্জ

কোথায় ছিলেন, কিভাবে ছিলেন, গোলাপগঞ্জে 'স্বপ্নের ঠিকানা' পাওয়া ৩ পরিবার

বিজ্ঞাপন

ফাহিম আহমদ: রোকিয়া বেগমের স্বামী আব্দুর রব। একজন কৃষক। মানুষের জমিতে করেন কৃষিকাজ। তাদের ঘরে ৪ জন ছেলে সন্তান রয়েছে। তারা গোলাপগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের চৌঘরী (মাঝরটিকর) গ্রামে ছোট্ট একটি কুঁড়ে ঘরে থাকতেন। জমিজমা বলতে কিছুই নেই। মাত্র দেড় শতক জায়গা ছিলো শাশুড়ির নামে। ছেলেকে দ্বিতীয় বিয়ে দিয়ে সেই দেড় শতক জায়গা লিখে দেন নিজের পছন্দের পুত্রবধূর নামে। তাও যে ঘরে সতীনের সাথে সন্তানদের নিয়ে রোকিয়া বেগম থাকতেন সে ঘরটির ভিতর দিয়ে সাপ-বিচ্ছু সব সময় প্রবেশ করতো। ছোট্ট একটি কুঁড়ে ঘরে এক রুমকে দুভাগ করে থাকতেন। বৃষ্টির দিনে অঝোরে পানি পরতো ঘরের ভিতরে। রাত বা দিনে শুয়ে থাকলে মাথার উপর দিয়ে ঘরের ভিতর থেকে আকাশ দেখা যেত।

রোকিয়া বেগম একেবারেই কান্নাজড়িত কন্ঠে প্রতিবেদককে বলেন, ৪ ছেলের মধ্যে সকল বড় ছেলে নাহিদ আহমদ ও ২য় ছেলে জাহিদ দুজনেই আলাদা আলাদা ওয়ার্কসপে কাজ করে। ৩য় ছেলে নাহিম একটি হিফজ মাদ্রাসায় ও ৪র্থ ছেলে নাজিম স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩য় শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। অভাবের এই সংসারে জীবনে ঘর করা তো দূরের কথা জায়গাও কিনতে পারতেন না।

তিনি বলেন, ‘আমি জীবনে স্বপ্নেও ভাবিনি যে আমার একটি ঘর হবে। আমাদের নিজস্ব জমি হবে। যেদিন ঘরের চাবি পেয়েছিলাম সেদিন খুশিতে অনেক কান্না করেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের জন্য ঘরের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমার এই ঘরটি পাওয়ার পিছনে স্থানীয় ইউপি সদস্য ফারুক আহমদ ঘরটি পেতে অনেক সহযোগিতা করেছেন। এজন্য আমাদের পরিবার চেয়ারম্যান ও মেম্বারের কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।’

সোমবার গোলাপগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের চৌঘরীতে ৭টি পরিবারের মধ্যে মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রদানকৃত ঘর পাওয়া পরিবারগুলো কেমন আছেন সেটা জানতে সরেজমিনে গেলে উঠে আসে তাদের জীবন-গল্প।

প্রধানমন্ত্রীর ঘর উপহার ঘর পাওয়া আরো একজন অসহায় নজরুল ইসলাম। তার বাড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নের চৌঘরী (মাঝরটিকর) গ্রামে। যিনি একটি ওয়ার্কসপে মেকানিকের কাজ করেন। ক্যান্সার আক্রান্ত স্ত্রী খালেদা বেগম, ৩ মেয়ে ও ১ ছেলে নিয়ে অভাবের সংসার। যেন নুন আন্তে পান্তা ফুরায়। ভিটেমাটি বলতে কিছুই নেই। থাকতেন বোনদের ভাগ পাওয়া জায়গায়। বাবার সম্পত্তি বলতে একেবারেই নগণ্য। মাত্র ১৩ শতক জায়গা। নজরুল ইসলাম দুই ভাইয়ের মধ্যে বড়। তাদের আরও ৬ বোন রয়েছেন। বাবার সম্পত্তি ১৩ শতক জায়গা সবাইকে ভাগাভাগি করে দেওয়া হয়েছে। নিজের নামের দেড় শতক জায়গা স্ত্রীর ক্যান্সার ধরা পরার পর স্ত্রীর চিকিৎসা করাবেন বলে অন্যের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। নিজের মাথা গোঁজার শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে স্ত্রীর চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন। যা টাকা দিয়ে বিক্রি করেছেন সেটা চিকিৎসার জন্য একেবারেই কম। মানুষের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকার ক্যামো দেন।

তিনি বলেন, ‘৪ সন্তান আমার। এরমধ্যে তিন মেয়ে ও এক ছেলে। বড় ছেলে ও ২য় মেয়ে স্থানীয় চৌঘরী গোয়াসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। ৪র্থ মেয়ে রাইশা ইসলাম শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধি। প্রতিদিন যা আয় করি তা দিয়ে সংসার চালানো বিরাট কষ্টসাধ্য। এর মাঝে এই ছোট্ট ৪ শিশু। এদের ভরণ-পোষণের ক্ষমতাও আমার নেই। শেষ সম্বলটুকু স্ত্রীর ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য বিক্রি করে দিয়েছি। মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে যখন দিশেহারা হয়ে পড়ি তখন দেখতে পাই এখন যেখানে প্রধানমন্ত্রীর ঘর উপহার পেয়েছি সে জায়গায় কাজ চলতেছে। আমি প্রথমে ভাবছিলাম এখানে হয়তো মাদ্রাসা বা অন্য কিছু হবে। তখন এখানের কন্ট্রাক্টরের সাথে কথা বললে তিনি বলেন এখানে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। তখন আমি তাদেরকে আমার সবকিছু খুলে বলি। ঘরটি পেতে আমাকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন পিআই স্যার, লিমন স্যার ও সাংবাদিক আব্দুল আহাদ চাচা। তাদের সহযোগিতায় আজ আমি স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে একটি সুন্দর ঘরে উঠতে পেরেছি। তা না হলে আমার পক্ষে জীবনে এরকম একটি ঘর বানানো সম্ভব হওয়ার নয়।’

আরেক পঞ্চাশোর্ধ স্বামীহারা মহিলা সত্তেরা বেগম। নিজস্ব জমিজমা বলতে কিছুই নেই। স্বামী মরহুম আনার মিয়া। স্বামীর মৃত্যুর আগে দুই সন্তানকে নিয়ে থাকতেন স্বামীর বাড়ি সদর ইউনিয়নের গোয়াসপুর গ্রামে। স্বামী আনার মিয়া পেশায় ছিলেন একজন বাবুর্চি। স্বামী মারা যাওয়ার পর সহজ-সরল সত্তেরা বেগমের জীবনে নেমে আসে গোর অন্ধকার। বড় ছেলে খোকন আলমের বয়স যখন ৫ তখন ছোট মেয়ের বয়স ছিল প্রায় ৫-৬ মাস। এ সময় তাদেরকে অকূল দরিয়ায় ভাসিয়ে আনার মিয়া পরপারে পাড়ি জমান।

সত্তেরা বেগম বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার কিছুদিন পর আমার স্বামীর ভাই আমাদেরকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। এসময় কোন উপায় না দেখে স্থানীয় জিলু মিয়ার বাড়িতে ঝি’য়ের কাজ নেই। প্রায় ৯বছর থেকে দুই সন্তানকে নিয়ে জিলু মিয়ার বাড়িতে আছি। মাসে ৭শ টাকা বেতন পাই। এখন নতুন বাড়িতে আসার যাওয়ার জন্য তারা আরও ৩শ টাকা বাড়িয়ে দিবেন বলেছেন।’

তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ‘সারাদিন ঝিয়ের কাজ করি। হাত-পায়ের অবস্থা নেই। এভাবে আর কতদিন করব। স্বামীকে হারিয়ে একেবারেই নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলাম। জীবনে একটি ঘর হবে বলে আশা করিনি। আজ প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় জায়গাসহ ঘর পেয়েছি। একবেলা না খেলেও সন্তানদের নিয়ে কিছুটা হলেও রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারব।’

এদিকে এ তিন পরিবার পরে ঘরের চাবি দেওয়ার পরও এখানে আর ৪ পরিবার এখন পর্যন্ত ঘরে উঠেননি। তিন পরিবার পরে বাকি ৪ পরিবারের কেউ না থাকায় তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

তবে এদের সাথে কথা বলে ও সরেজমিন দেখা যায়, ঘরের ভিতরে বাথরুম আছে তবে বাথরুমের ময়লা যাওয়ার জন্য কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। তাদেরকে দিয়ে রিং বসানোর গর্ত করানো হলেও এখন পর্যন্ত সেখানে রিং দেওয়া হয়নি। এজন্য তারা বাথরুমের জন্য বিরাট অসুবিধায় আছেন। এমনকি ময়লা যাওয়ার জন্য কোন ড্রেনেজ ব্যবস্থা করা হয়নি। বিদ্যুতের লাইন টানা হলেও মিটার সংযোগ না হওয়ায় তারা বিদ্যুৎতের আলো থেকে বঞ্চিত। টিউবওয়েলের নিচ পাঁকা না হওয়ার কারণে পানি পড়ে নিচে কাঁদা জমে যায়। রান্না ঘরের ব্যবস্থা হলেও আগুনের ধোঁয়া বের হওয়ার জন্য কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। আশ্রয়ণ প্রকল্পের পাশে একটি মাদ্রাসা থাকায় মহিলারা বাইরে বের হতে পারেন না। এজন্য অন্তত মাদ্রাসার পাশে একটি বাউন্ডারি দেয়াল করে দেওয়ার জন্য তারা অনুরোধ জানান।

এ বিষয়ে উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা হাবিবুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করে হলে তিনি বলেন, অনেক কাজ। সবদিকে যেতে হয়। রিং না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনি যখন দেখে এসেছেন গর্ত হয়ে গেছে আগামীকাল আমরা রিং পাঠিয়ে দিব। আর বাথরুমের ময়লা যাওয়ার জন্য শীঘ্রই ড্রেনেজ ব্যবস্থা করা হবে।

বিদ্যুতের মিটারের বিষয়ে তিনি বলেন, পল্লী বিদ্যুতের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। তারা বলেছে লাইন টানার বাকি রয়েছে। লাইন টানা হলে মিটার সংযোগ দেওয়া হবে।

তিনি বলেন, রান্না ঘরের আগুনের ধোঁয়া বের হতে বা বাউন্ডারি ওয়াল করতে কিছু সময় লাগবে। আপাতত এগুলো হবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এদিকে পরে লক্ষ্য রাখবেন।

বিজ্ঞাপন

জনপ্রিয় সংবাদ