বিজ্ঞাপন
জাহিদ উদ্দিন : ৩জন বীর উত্তম, ৬জন বীর বিক্রম, ৪জন বীর প্রতিক সহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমি গোলাপগঞ্জ উপজেলা। এ উপজেলারই বীর সাহসী সন্তান হলেন বীর উত্তম, বীর প্রতিক আফতাব আলী। আফতাব আলী গোলাপগঞ্জ উপজেলার ভাদেশ্বর দক্ষিণভাগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম ইদ্রিস আলী ও মায়ের নাম জোবেদা খানম।
মুক্তিযোদ্ধে আফতাব আলী সাহসী এক দলনেতা ছিলেন। তিনি সৈয়দপুর সেনানিবাসে ১৯৭১ সালে সুবেদার পদে কমর্রত ছিলেন। মার্চ মাসে তার কোম্পানি ছিল পলাশবাড়ীতে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে অবস্থান নেন রৌমারীতে। এপ্রিল মাসের ১৪ বা ১৫ তারিখে তিনি রৌমারী থানা দখল করেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের কাছে আফতাব আলী ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক। অসংখ্য পাকিস্তান সমর্থককে প্রকাশ্যে গুলি করে শাস্তি দেন তিনি। জীবনের তোয়াক্কা না করে একের পর এক পাকিস্তানিদের বিপর্যস্ত করে দেন। আফতাব আলী যুদ্ধে পাকিস্তানিদের গুলিতে একবার আহত হন। তার দুই পায়ে চারটি গুলি লাগে। পাকিস্তানিদের গুলী এই সাহসী বীরকে থামাতে পারেনি। একটু সুস্থ হয়েই আবারো তিনি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য সাহস ও বীরত্বের জন্য আফতাব আলীকে বীর উত্তম ও বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ২৯ ও ৬৩।
বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সূত্রে জানা যায়, এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেলটা কোম্পানির একাংশ বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহিরা সুবেদার আফতাব আলীর নেতৃত্বে বর্তমান গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী থেকে রৌমারীর চরা লে অবস্থান নেয়। সেখানে আফতাব আলী তাঁর দলে স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি আগস্ট মাসের প্রথমার্ধ পর্যন্ত গোটা রৌমারী এলাকা মুক্ত রাখতে সক্ষম হন।
এরপর ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের প্রথমার্ধে কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী উপজেলার অন্তর্গত কোদালকাঠিতে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে তুমুল মুখোমুখি যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর নেতৃতে¦ ছিলেন আফতাব আলী। মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে তাঁর নেতৃত্বে বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকলেন। বিকেল, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো। পরদিনও যুদ্ধ চলল। তৃতীয় দিন দুপুরের পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দিক থেকে গোলাগুলি কমতে থাকল। রাতে একেবারে গোলাগুলি বন্ধ হয়ে যায়।
৪ আগস্ট পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরাট একটি দল রৌমারী দখলের উদ্দেশ্যে কোদালকাঠিতে আক্রমণ করে। ব্যাপক আর্টিলারি গোলাবর্ষণে মুক্তিযোদ্ধারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এই সুযোগে পাকিস্তানিরা কোদালকাঠি দখল করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী শক্তি মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ছিল। সে সময় সমর কৌশলী আফতাব আলী পাকিস্তানি সেনাদের পাল্টা আক্রমণ না করে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য কাজ করে যান। কয়েক দিনের মধ্যেই মুক্তিবাহিনীর আরও কয়েকটি দল আফতাব আলীর দলের সাথে এসে যুক্ত হলে তাঁর শক্তি আরো বৃদ্ধি পায়। তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী কোদালকাঠিতে অবস্থান নিয়ে রৌমারী দখলের চেষ্টা করতে থাকে।
অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সে প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে থাকেন। দুই-তিন দিন পরপর সেখানে অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এসব যুদ্ধে তিনি যথেষ্ট সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। তাঁর সাহসিকতায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রৌমারী দখলের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। দুই দিন তুমুল যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনারা কোদালকাঠি থেকে পালিয়ে যায়। এরপর গোটা রৌমারী এলাকার পুরোপুরি অ ল মুক্তিবাহিনী হাতে আবার চলে আসে।
১৯৭৯ সালে অনারারি ক্যাপ্টেন হিসেবে আফতাব আলী সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নেন। তিনি দাম্পত্য জীবনে তাহেরা খানমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর দুই ছেলে, পাঁচ মেয়ে রয়েছে। বাংলার এই সাহসী বীর ২০১৭ সালের ৩১ জানুয়ারী সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে বাড়ি থেকে নেওয়ার পথে মাধবপুর এলাকায় মারা যান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর।