বিজ্ঞাপন
খায়রুল ইসলাম সুহেব : সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ ঢাকাদক্ষিণ পরগণা সূদুর প্রাচীন কাল তথা সুলতানী আমল থেকে বাংলাদেশের মধ্যে একটি বিশিষ্ট স্থান বলে পরিচিত। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের পিতৃ-পুরুষ ভূমি এবং আরো ও অনেক জ্ঞানী-গুণী হিন্দু মুসলমান ভদ্র মহোদয় গণের অাবাস্থল হিসেবে এ এলাকার বিশেষ খ্যাতি আছে।
কি শিক্ষা,কি সংস্কৃতি,অর্থ- প্রতিপত্তি সব দিক দিয়ে এই এলাকা গোলাপগঞ্জ তথস সিলেট জেলার মধ্যমনি হিসেবে বিরাজিত। তাই এই এলাকায় একটি মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা একান্ত রূপেই অত্যাবশ্যক ছিল। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনের নানা দৌরাত্ম্যে এলাকাবাসী একান্ত ইচ্ছা ও আন্তরিকতা স্বত্ত্বে ও ১৯৬৯ সনের পূর্বে খুব একটা এগিয়ে আসতে পারেনি। ১৯৬১ ইং সনের গোড়ার দিকে স্থানীয় ঢাকাদক্ষিণ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি ঢাকাদক্ষিণে একটি কলেজ স্থাপনের ব্যাপারে একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহন করে।
যতদূর মনে পড়ে- ঐ কমিটিতে সর্ব জনাব মরহুম তফজ্জুল আলী,ইসমাইল আলী,আবদুল মন্নান,কালীপদ চৌধুরী ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক স্বর্গীয় ক্ষীরোদ চন্দ্র দাস পুরকায়স্থ প্রমুখ বিশিষ্ট ভদ্র মহোদয় গণ সামিল ছিলেন। ১৯৬৯ ইং সনের শুরুতেই কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রথমে স্থানীয়ভাবে ও পরে বৃহত্তর ঢাকাদক্ষিণ পরগণা তথা কুশিয়ারা বেল্টের বিদ্যুৎসাহী ভদ্র মহোদয়গণের সমবায়ে বিস্তৃত সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ১৫৯ জন সদস্য সমবায়ে একটি অর্গেনাইজিং কমিটি গঠিত হয়।
তৎকালীন সিলেটের জেলা প্রশাসক জনাব মোকাম্মেল হক সাহেবের অশীতিপর বৃদ্ধ পিতা কবি জনাব মোজেম্মল হক ঢাকাদক্ষিণ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি সভায় শোভাগমণ করে এলাকায় কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যেগকে উৎসাহিত ও গতিময় করে তুলেন। তাঁর আগমন ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তদানীন্তন সিলেট জেলা রেড ক্রসের সভাপতি জনাব সিরাজ উদ্দিন আহমদ এর পরপরেই সিলেট জেলা প্রশাসন কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আন্তরিক আগ্রহ দেখাতে শুরু করে। অতঃপর জেলা প্রশাসক মহোদয়কে সভাপতি করে একটি ১৫৯ সদস্য বিশিষ্ট অর্গানাইজিং কমিটি আত্ন প্রকাশ করে।
রায়গড়,কানিশাইল,দত্তরাইল,নগর,শিলঘাট,বারকোট,নিশ্চিত, খর্দাপাড়া,নালিউরী,মুকিতলা প্রভৃতি গ্রামের আপামর জনসাধারণ চাঁদা দান প্রভৃতি প্রদান করে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় পনেরো হাজার টাকার একটি তহবিল গঠন করে।
পরবর্তীতে স্থান নির্বাচনের প্রশ্নে মতানৈক্য দেখা দিলে একটি সুগম অথচ বাজার থেকে দূরবর্তী স্থান নির্বাচনের সমস্যা দেখা দেয়। কেউ প্রস্তাব করেন রায়গড় অঞ্চলে কেউ বারকোটের বাসাবাড়িতে আবার কেউ রাধাজুরী তীরবর্তী শনিবারী বাজারে।
এই সময় কানিশাইল নিবাসী মরহুম এমলাক আলী সাহেবের মধ্যমপুত্র বর্তমান লন্ডন প্রবাসী জনাব মজির উদ্দিন (টুনু মিয়া) অগ্রসর হইয়া বলেন যে,তিনি কলেজের জায়গা দিবেন।সেই জায়গাটি তাদের পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে বাড়িঘর নির্মাণের জন্য নির্ধারিত ছিল যা দেওর টিলা নামে পরিচিত। সমবেত সভাস্থলের সবাই “মারহাবা’ “মারহাবা’ বলে তাহাকে অভিনন্দিত করেন। তাৎক্ষণিক ভাবে অর্গেনাইজিং কমিটির সদস্যবৃন্দ তাহাদের বাড়ি সংলগ্ন স্থানটি গিয়ে পরিদর্শন করেন এবং তাহা কলেজ স্থাপনের জন্য উপযুক্ত বলে রায় দেন।
এরপর তার শয্যাশায়ী পিতা ও মাতার অনুমতিক্রমে ১৯৬৯ সনের জুন মাসে জায়গাটি কলেজের নামে রেজিস্ট্রারী করিয়া দেওয়া হয়। জায়গার পরিমাণ ৫.৩০ একর। শিক্ষার উন্নয়নে তাদের পরিবারের এই ত্যাগ একটি অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত রূপে চির উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। কলেজ কমিটি তাদের দানের প্রতি কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ জায়গার বৃহদাংশের মালিক এমলাক আলী সাহেবের স্ত্রী নজমুন্নেছা খাতুন কে কলেজের স্থায়ী সদস্যরূপে গ্রহনের প্রস্তাব দিলে তিনি তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র আফতাব উদ্দিন ননী মিয়া সাহেবকে তাঁর প্রতিনিধি রূপে সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।
তাছাড়া এমলাক আলী সাহেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র মরহুম আছির উদ্দিন (সারি মিয়া) তৃতীয় পুত্র সফিক উদ্দিন ও চতুর্থ পুত্র মানিক মিয়া লন্ডন প্রবাসী নগরের মইন মিয়াস্থ অত্র এলাকার লন্ডন প্রবাসী শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের সমবায়ে ঢাকাদক্ষিণ কলেজ সাহায্য সমিতি নামে লন্ডনে একটি সমিতি গঠন করেন। ১৯৬৯ ইং থেকে ১৯৭৫ ইং পর্যন্ত প্রায় লক্ষ টাকার মত দান করেছেন। এই মুহুর্তে সবার নাম উল্লেখ করা সম্ভব নয় বলে আমি আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি।
পরবর্তী কালে কলেজের স্থাপনা ব্যাপারে বারকোট নিবাসী অবসরপ্রাপ্ত এডিসি মরহুম সফিক উদ্দিন আহমদ,মরহুম তফজ্জুল আলী,গোলাম ইরমানী সাহেব,কানিশাইলের মরহুম সালাউদ্দিন ফারুক,আবুল বশর চৌধুরী, এবং নগর গ্রামের মরহুম উমর আলী সাহেব,প্রয়াত ক্ষীরোদ চন্দ্র দাস পুরকায়স্থ বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। আলোচ্য প্রতিবেদনকারী কলেজের সূচনা লগ্ন থেকে অধ্যক্ষ হিসেবে সেই ১৯৬৮ ইং থেকে কলেজ প্রতিষ্ঠার যাবতীয় কর্মকান্ডের সহিত নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে পেরে নিজেকে ধন্য ও কৃতার্থ মনে করছেন।
তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে কলেজের জন্য অর্থ সংগ্রহ ব্যাপারে স্থানীয় যুবকবৃন্দ যেভাবে এগিয়ে এসেছিলেন তাতে কলেজের অস্তিত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা রেখেছেন। এই স্বল্প পরিসরে তাদের সবার নাম উল্লেখ না করে আমি তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
উল্লেখ্য যে,ঢাকাদক্ষিণ কলেজের কর্মকান্ড ১৯৬৯ সনে প্রথমে আরম্ভ হয় ঢাকাদক্ষিণ বাজার স্থিত ঢাকাদক্ষিণ হাই স্কুলের পরিত্যাক্ত ভবনে। পরে ১৯৭৪ সনে নিজস্ব স্থানে কলেজ স্থানান্তরিত হয়। এই পর্যন্ত কলেজের জন্য সবচেয়ে বেশী নগদ অর্থ সাহায্য প্রদানকারীদের মধ্যে রণকেলী নিবাসী মরহুম ওজি উদ্দিন চৌধুরী এবং ভাদেশ্বর নিবাসী আমেরিকা প্রবাসী সালেহ আহমদের নাম উল্লেখ্যযোগ্য। এরা উভয়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা করে কলেজ কে এককালীন অর্থ সাহায্য প্রদান করেছেন। তাহাছাড়া খাটকাই নিবাসী ময়না মিয়া,দক্ষিণ কানিশাইল নিবাসী আবুল মতিন ইঞ্জিনিয়ার ( মতি মিয়া) সৈয়দ মকবুল হোসেন( লেচু মিয়া) এবং গোলাপগঞ্জের মরহুম আবদুর রহমান প্রত্যেকে দশ হাজার টাকা করে কলেজকে সাহায্য করেছেন।
এছাড়াও স্থানীয় সাবরেজিষ্ট্রী অফিস,পরিবহন সমিতি কলেজ কে বিভিন্ন সময়ে চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে আর্থিক সাহায্য দিয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে অনেকে পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন অর্থ বরাদ্দ বিভিন্ন সময়ে কলেজকে অর্থ প্রদান করায় কলেজটি তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছে। ঢাকাদক্ষিণ বাজার বণিক সমিতি ও এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। দত্তরাইল নিবাসী জনাব রকিব উদ্দিন রোকেয়া মিয়ার সাহায্য ও নেতৃত্বে কলেজের জন্য দুই দুই বার মালজোড়া গানের আসর বসিয়ে অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ঢাকাদক্ষিণ ক্রীড়া চক্রের উদ্যেগেও একবার কলেজের সাহায্যর জন্য ফুটবল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। তাছাড়া ১৯৭৭ সনে গোলাপগঞ্জের বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মেম্বার পদ প্রার্থীদের জামানতের টাকা সংগ্রহ করেও কলেজের আর্থিক দুর্দশা লাঘব করা হয়েছে।।
এইভাবে এলাকার বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিগণ থেকে শুরু করে সাধারণ জনমানুষের ও ঢাকাদক্ষিণ কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যে ভূমিকা ও অবদান রেখেছে তার ঋণ কলেজ কর্তৃপক্ষ কোন দিন শোধ করতে পারবেনা। পাকিস্থান আমল থেকে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ ও কলেজকে নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে কলেজ কর্তৃপক্ষ কে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন।
এদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য চন্দরপুর নিবাসী মরহুম মইন উদ্দিন খাঁন,শিলঘাট নিবাসী আহমদ মিয়া,রণকেলী নিবাসী মেজর জেনারেল সফি আহমদ চৌধুরী, ফুলবাড়ি নিবাসী ওয়াজী আহমদ চৌধুরী, ভাদেশ্বর নিবাসী হেদায়েত আহমদ,বারকোট নিবাসী এনাম আহমদ চৌধুরী প্রমুখের নাম সবিশেষ উল্লেখ্য। তাছাড়া কলেজের চাঁদা আদায়ের কাজে হাজী তমছির আলী,হাজী মদরিছ আলী, মহিব উদ্দিন,আবদুল মুতলিব ও বিল্লাল ভাই – এর কাছে কৃতজ্ঞ জ্ঞাপন করছি। স্বল্প পরিসরের দরুন কলেজ প্রতিষ্ঠার আরো ও অসংখ্য ব্যক্তিবর্গ যারা বিভিন্ন ভূমিকা পালন করেছেন- তাদের নাম উল্লেখ করতে না পারায় তাদের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
কলেজ এখনও পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠা পায়নি। এটি এখনো অবকাঠামোগতভাবে অত্যান্ত দূর্বল ভীতের উপর প্রতিষ্ঠিত। এর আরো ও ব্যাপক উন্নতির প্রয়োজন। কলেজের উন্নয়নের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার জন্য আমি এলাকার আপামর জনসাধারণের নিকট আবেদন জানাচ্ছি।
অতি সম্প্রতি কানিশাইল নিবাসী মরহুম আবদুল লতিফ( লয়লু মিয়া) সাহেবের লন্ডন প্রবাসী তরুণ পুত্র মোঃ মুজিবুর রহমান কলেজের জন্য একটি তোরণ নির্মাণ করিয়ে দিয়ে সেবা ও বদান্ততার অপূর্ব নিদর্শন রয়েছে। তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে এলাকার স্বচ্ছল ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ কলেজের উন্নয়নে এগিয়ে আসবেন এই কামনা ও আবেদন রেখে আমার প্রতিবেদন শেষ করলাম।
লেখক কথা
প্রতিবেদনের তথ্য দিয়ে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন ঢাকাদক্ষিণ ডিগ্রি কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ নীলোৎপল বড়ুয়া স্যার যিনি একাধারে দীর্ঘ ৩৬ বৎসর অত্র কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন,তিনি আমার শিক্ষাগুরু বটে। স্যার এখন ইহজগতে নেই,কিন্তু তাঁর কর্মময় জীবন যতদিন ঢাকাদক্ষিণ সরকারি কলেজ থাকবে ততদিন চীরস্বরণীয় থাকবে। এবং আমার আরেক শিক্ষাগুরু ঢাকাদক্ষিণ ডিগ্রি কলেজের প্রাক্তন সহকারি অধ্যাপক যিনি কর্মময় জীবনে একাদশ ও দ্বাদশে পৌরনীতি ও স্নাতক শ্রেণীতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠদান করাতেন।