বিজ্ঞাপন
সাত্তার আজাদ : শ্যামল বাংলার অজপাড়া গাঁয়ের কত মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে, তার কি হিসাব আছে? সশস্ত্র, সুসজ্জিত পাক সেনার সাথে আমরা লড়াইয়ে ঠিকতে পারতাম না, যদি না গ্রামের-গঞ্জের মানুষ ঝাপিয়ে পড়তেন মুক্তির সংগ্রামে। সে হিসেব কষলে আমরা সেইসব মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানাতে পারিনি অদ্যাবধি। তবু সীমিত পরিসরে হলেও কোথাও কোথাও জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্মান দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে কোনো কোনো গ্রামে, পাড়া-মহল্লায়।
সেরকম তিনটি গ্রাম খুঁজে পাওয়া গেল সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায়। সেই উপজেলার তিনটি গ্রামের রাস্তার নামকরণ করা হয় মুক্তিযোদ্ধার নামে। কাজটি করে মুক্তিযোদ্ধাদের মান-মর্যাদা বাড়ালেন তাঁরা। জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অন্তত মনে রেখেছেন গ্রামের লোকজন। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ কাজটি করে ঋণ শোধের চেষ্টা করেছেন গ্রামবাসী।
কোনো কোনো সময় এমন কিছু কাজ এলাকা বা গ্রামকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলে। সেরকমই গ্রাম গোলাপগঞ্জের হেতিমগঞ্জের কুসামবাগ, হেতিমগঞ্জ গ্রাম ও দক্ষিণ বাঘা। আরও দু-দশটা গ্রামের মত সেই গ্রামগুলোর মাটির বৈশিষ্ট এক হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানিয়ে গ্রাম তিনটি এক অনন্য উচ্চতায় ওঠে গেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম সম্মান দেখাতে পেরে গ্রামগুলোর মানুষেরাও কৃতার্থ। মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল মান্নান ওরফে মনু মিয়ার বাড়ি ৩ নং ফুল বাড়ি ইউনিয়নের কুসুমবাগ গ্রামে।
গ্রামের রাস্তাটি এই শহীদের নামে নামকরণ করা হয়েছে। গ্রামের ট্রাক চালক মো. কামাল উদ্দিন বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। কেউ জীবন হারিয়েছেন। কেউ বেঁচে আছেন। আমরা কি দিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধাদের ঋণ শোধ করব। গ্রামের রাস্তার নাম শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে হওয়াকে খুশি। মন্টি দেব বলেন, আমি হিন্দু। পাকিস্তানিরা আমরা হিন্দুদের খুব বেশি অত্যাচার করেছে। সে সময় মুক্তিযোদ্ধারাই আমাদের রক্ষা করেছে। তাদের ঋণ শোধ হবার নয়। রাস্তার নামকরণ দিয়ে কি একজন মুক্তিযোদ্ধার ঋণ শোধ করা যায়। গ্রামের মইজ উদ্দিন জানালেন, মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে উদ্যত ছিল। কেউ কেউ প্রাণ দিয়েছেন। তাদের একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে রাস্তার নাম হওয়াতে ভাল লাগছে। শায়েক আহমদ জানালেন, মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, গল্প শুনেছি। মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেছে। মা-বোনের ইজ্জত রক্ষা করেছে। তাদের জন্য রাস্তার নামকরণ খুবই তুচ্ছ বিষয়। আরও বড় কিছু হওয়া দরকার। লায়েক আহমদ বলেন, যারা আমাদের জন্য রক্ত ঝরাল, আমরা কি দিয়ে তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব। এই মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের মাথার মুকুট।
বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ জুম্মা মিয়া বীর বিক্রমের বাড়ি হেমিতগঞ্জ। এই বীরের সম্মানে হেতিমগঞ্জ গ্রাম রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ জুম্মা মিয়া বীর বিক্রম সড়ক’।
এ রাস্তাটির নামকরণ মুক্তিযোদ্ধার নামে হওয়াতে গ্রামবাসী খুশি। তাদের অনেকের বক্তব্য হল- একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার গ্রামে জন্ম নিয়ে আমরা গর্বিত।
গ্রামের পাশে ব্যবসা করেন মো. সোহেল আহমদ। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। কিন্তু গর্ববোধ করি এই কারণে যে আমাদের গ্রামের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন স্বাধীনতার সংগ্রামে। তাঁর প্রতি সম্মান দেখাতে আমরা রাস্তার নামকরণ করে দিই। গ্রামের আরেক ব্যবসায়ী আব্দুল মতিন বলেন, আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশের সকল মুক্তি সংগ্রামী মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়েছি। তাদের ত্যাগের প্রতি আমাদের সম্মান দেখানোর ভাষা নেই। তারপরও গ্রামের রাস্তাটি শহীদের নামে উৎসর্গ করায় খুশি।
ইকবাল আহমদ বলেন,মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন না করলে গ্রামই থাকত না। হয়ত আমরাও থাকতাম না। যাদের জন্যে গ্রাম, নগর, দেশ ও দেশের স্বাধীনতা পেয়েছি, তাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ। জাফরান আহমদ বলেন, এই বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্য রাস্তা কেন গ্রামের নাম দিলেও কম হত। রাস্তার নামকরণ বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে হওয়াতে ঋণের বোঝা কিছুটা কমেছে।
হেলাল আহমদ বলেন, যাদের কারণে আজ আমরা স্বাধীন হলাম। যাদের রক্তে লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা পেলাম। একটি দেশ পেলাম। তাদের ঋণ এক জীবনের শোধ হবে না। একটি রাস্তার নামকরণ দিয়ে কি মুক্তিযোদ্ধার ঋণ শোধ করা যায়?
গোলাপগঞ্জের দক্ষিণ বাঘা গ্রামে একটি গেটের নাম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সায়েফ উদ্দিন চৌধুরী (সুফী) স্মৃতি তোরণ। এটি স্থাপিত হয় ২০০৯ সালে। সেই গ্রামে শুধু সায়েফ উদ্দিন চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েননি। সেদিন গ্রামের অনেকেই মুক্তির সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেন। গ্রামটির মুক্তিযুদ্ধের এক উজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে গ্রামের গেট করাতে সকলেই খুশি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এই ক্ষুদ্র প্রয়াস দিয়ে আমাদের গর্বের ধন মুক্তিযোদ্ধাদের ঋণ শোধ হবার নয়।
তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা ধীরে ধীরে পরলোকগমন করছেন। এখনও তো মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।