বিজ্ঞাপন
ডেস্ক রিপোর্ট : বাড়ির যেকোনো কাজে সবার আগে ছুটে যাওয়া মেয়েটির নাম নদী। যেমনই দুরন্ত, তেমনই শীতল। কারও কষ্ট দেখলেই চোখ ছলছল করে তার। অথচ এখন তার থমকে যাওয়া জীবন দেখে প্রতিনিয়ত কাঁদছে বাড়ির লোকজন ও সহপাঠীরা।
নদীর গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার নিজামপুর ইউনিয়নের সৈয়দপুরে। ১২ বছর ধরে সে বাবা-মায়ের সাথে শায়েস্তাগঞ্জ পৌর এলাকার দক্ষিণ বড়চরে ভাড়া থাকে।
হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ ইসলামী একাডেমি অ্যান্ড হাইস্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে নদী। পড়ালেখায়ও বেশ আগ্রহ তার। কারও অসুস্থতা ও সমস্যায় সাধ্যমতো পাশে দাঁড়াতো সে। তার এসব কর্মকাণ্ড অনেক দিন ধরেই লক্ষ্য করছিলেন বাবা রফিক মিয়া।
মেয়ের এসব গুণ দেখে তিনি স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিলেন নদীকে ডাক্তার বানানোর। কিন্তু হঠাৎ এক দুর্ঘটনা সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে তার। যে মেয়েকে ডাক্তার বানিয়ে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করতে চেয়েছিলেন, সেই মেয়েকে বাঁচাতে এখন তিনি ছুটছেন এদিক সেদিক।
ঘটনাটি চলতি বছরের ১৫ মে’র। এদিন নদীর জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ এক দুর্ঘটনা। বিকেলে বাসার পাশে একটি নির্মাণাধীন ভবনের ছাদে সহপাঠীদের সঙ্গে খেলছিল নদী। ওইদিন বাসার ওপর দিয়ে যাওয়া বিদ্যুৎ লাইনের তারটি খুলে রাখা হয়েছিল ছাদে। পাশেই জমানো পানিতে পড়েছিল আরও একটি তার। খেলতে খেলতে ওই পানিতে পা পড়ে যায় নদীর। এতে গুরুতর আহত হয় সে। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হবিগঞ্জ ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সেখানে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে সিলেট ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে নদীকে ঢাকা শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়।
সেখানে গত ৪ জুন নদীর দুটি পায়েরই হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়। এছাড়া শরীরের বিভিন্ন পুড়ে যাওয়া অংশ সার্জারি করা হয়। প্রায় তিন মাস চিকিৎসা শেষে টাকার অভাবে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি চলে আসেন বাবা রফিক মিয়া। এখনও তার অনেক চিকিৎসা বাকি।
মেয়ের চিকিৎসার অর্থ জোগাতে ঘুরছেন আত্মীয়-স্বজনের কাছে। মেয়ের চিকিৎসার খরচের জন্য অনেকের কাছে গেলেও নিরাশ হয়ে ফিরছেন। রফিক মিয়ার দিনরাত কাটছে বিষণ্নতা আর হতাশায়।
কাপড় ব্যবসায়ী বাবা রফিক মিয়া জানান, গ্রামের জমি-জায়গা ও প্রাইভেটকার বিক্রি করেও চিকিৎসার খরচ কুলানো যায়নি নদীর। পরে আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকেও টাকা ধার করতে হয়েছে। এ পর্যন্ত চিকিৎসা বাবদ ১৯ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, আমার পক্ষে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। তার স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে হলে দুটি কৃত্রিম পা লাগানো প্রয়োজন। এতে প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ হবে। কোথায় পাব এতো টাকা।
তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে ৬৫ হাজার টাকার সহযোগিতা পেয়েছেন। কুয়েত প্রবাসী তিনজন তাকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।
নদীর খেলার সাথী রিতু জানায়, বাসার ছাদে পানিতে নদী পা দিতেই বিদ্যুতে জড়িয়ে যায়। সাথে সাথে রিতু নদীর মাকে ঘটনাটি জানায়।
রিতু আরও জানায়, আগে প্রতিদিন বিকেলে নদীর সাথে খেলা করতো। এখন নদীর পা না থাকায় এক সাথে খেলতে পারে না তারা।
প্রতিবেশী সাবেক কাউন্সিলর আসম আফজল আলী ও আমিনুল ইসলাম চান মিয়া জানান, নদী পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও ভালো ছিল। এ ঘটনার তারা সামাজিকভাবে বিষয়টি নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু ওই বাসার মালিক মর্জিনা বেগম তাদের এ প্রস্তাবে সাড়া দেননি।
স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল জলিল বলেন, বিদ্যুতের মেইন লাইন থেকে অবৈধভাবে তার দিয়ে বাসার মালিক বিদ্যুৎ ব্যবহার করায় নদীর মতো মেধাবী ছাত্রীর আজকে এ পরিণতি।
নদীর স্কুল শায়েস্তাগঞ্জ ইসলামী একাডেমি অ্যান্ড হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুর রকিব বলেন, নদী অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী। তার বাবার স্বপ্ন ছিল মেয়েকে চিকিৎসক বানানোর। এ স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। নদীর উন্নত চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা প্রয়োজন। তিনি সবার সহযোগিতা কামনা করেন।
এ ব্যাপারে শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান গাজীউর রহমান ইমরান বলেন, ঘটনাটি খুবই হৃদয়বিদারক। মেধাবী ছাত্রী নদীর জন্য উপজেলা পরিষদ থেকে সহযোগিতা করা হবে। নদীর বাবা আর্থিক সহযোগিতার জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর আবেদন করেছেন।
এ বিষয়ে শায়েস্তাগঞ্জ থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মোজাম্মেল হোসেন বলেন, নদীর পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে। আমরা আসামিকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠিয়েছি।